Thursday, September 24, 2020

প্র্যাকটিস যে কোন কিছুর জন্য গুরুত্বপূর্ণ,

 একদিন বৃষ্টির দেবতা ইন্দ্র কৃষকদের উপর অনেক ক্ষেপে গেলেন..

তখন তিনি কৃষকদের,
-আমি একটানা ১২ বছর কোন প্রকার বৃষ্টি দান করব না,তোমরাও কোন প্রকার ফসল ফলাতে পারবে না "বলে অভিশাপ দিলেন..

কৃষকদের তো তখন ভয়ে অবস্থা খারাপ, তারা তখন অনেক কাকুতি মিনতি করতে শুরু করলো তার অভিশাপ ফিরিয়ে নেয়ার জন্য..



কৃষকদের কাকুতি মিনতি দেখে সে একটা বুদ্ধি বের করলো..
সে কৃষকদের বললো -আচ্চা ঠিক আছে বৃষ্টি তখনি হবে যখন ভগবান শিব তার তার হাতে থাকা ডমরু বাজাবেন..

এক দিকে তিনি কৃষকদের এটা বলে শান্তনা দিলেন যে ভগবান শিব ডুমরু বাজালে বৃষ্টি হবে অন্য দিকে তিনি শিবকে ডমরু না বাজানোর জন্য রাজি করিয়ে নিলেন..

কৃষকেরা যখন শিবের কাছে ডমরু বাজাতে

 প্রার্থনা করলো তখন তিনি বলে দিলেন "আমি ১২ বছর আমার ডমরু বাজাবো না "

তখন কৃষকরা কোন পথ না পেয়ে ১২ বছর অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলো..

কিন্তু একজন কৃষক ঠিকি জমি খনন করে চাষ করে বীজ বুনন করতে থাকলো..
কিন্তু বার বারই তার বীজ নষ্ট হতে লাগ

লো কোন ফসলই হলো না..

তাকে দেখে অন্য চাষিরা ও হাসাহাসি করতে লাগলো..
৩ বছর পর একদিন সব কৃষক মিলে তাকে জিজ্ঞেস করলো,
- কেনো তুমি শুধুশুধু এত কষ্ট করছো বৃষ্টিতো হবে না ১২ বছর.. বৃষ্টি ছাড়া কি ভাবে ফসল হবে..

উত্তরে সে বললো,-আমি জানি ১২ বছর কোন বৃষ্টি হবে না,তবুও আমি আমার কাজটার অনুশীলন করে যাচ্ছি.. যেনো ১২ বছর পর যখন বৃষ্টি হবে তখন আমি আমার চাষবাস এর কাজ ভুলে না যাই..

কৃষকদের মধ্যকার এই কথা শুনে দেবী পার্বতী শিবকে বললেন -এক টানা ১২ বছর ডমরু না বাজালে

আপনি ও হয়তো ১২ বছর পর ডমরু বাজানো ভুলে যাবেন..

তখন শিব অন্যমনস্ক হয়ে তার হাতে থাকা ডমরুটা বাজানোর জন্য চেষ্টা করলেন..ডমরু বাজতেই বৃষ্টি পড়া শুরু হয়ে গেলো..

আর যে কৃষক আগে থেকে জমি তৈরি করে বীজ বপন করে রেখেছিলো সে শস্য পেতে লাগলো.. সেখানে যারা তাকে নিয়ে হাসাহাসি করছিলো তারা কিছুই পেলো না..

——————

প্র্যাকটিস যে কোন কিছুর জন্য গুরুত্বপূর্ণ, আমরা যতই কোন কিছুতে দক্ষ হই না কেনো যদি আমরা ভালো মত সেটার অনুশীলন না করি তা হলে নির্ঘাত ঐ কাজটা আস্তে আস্তে আমাদের আয়ত্তের বাহিরে চলে যাবে..

নিজের কাজটা তাই অলয়েজ অনুশীলন করা উচিত..যেনো সেটা না ভুলে যাই, পিছিয়ে না পরি.. নিজের স্কিলের উপর ফোকাস করুন সব সময় নতুন কিছু করার ট্রাই করুন যেনো পরবর্তী চ্যালেঞ্জ গুলা মোকাবেলা করতে পারেন..

Saturday, September 12, 2020

*গাদিরে-খুম এর ঘটনা*

*গাদিরে-খুম এর ঘটনা*

“গাদির” অর্থ জলাশয়। জায়গার নাম খুম।


রসুলুল্লাহ (আ) জীবনে একবার মাত্র হজ্ব পালন করেছিলেন। মক্কা শহরকে চির বিদায় জ্ঞাপন করে তিনি জন্মস্থান ত্যাগ করলেন। এই জন্য ইহাকে বিদায় হজ্ব বলা হয় এবং তাঁর দেওয়া এই ভাষনকে “বিদায় ভাষন” বলা হয়, যেহেতু ইহা ছিল জন্মভূমির প্রতি শেষ ভাষন।
মক্কায় অবস্থিত সকলকে বিদায় সম্ভাষণ করে নিজে এহরামের পোশাক না ছেড়েই মদীনার পথে রওনা হলেন। প্রায় সোয়া লক্ষ লোক তাঁর সহযাত্রী ছিলেন।
পথে ১৮ই জিলহজ্ব তারিখে শনিবার দিন জোহর এবং আছরের নামাজের মধ্যবর্তী সময়ে মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী “জুফায়” যখন তিনি ‘গাদিরে খুম’ নামক জায়গায় উপস্থিত হলেন তখন এই আয়াত নাজেল হইলঃ-
হে রসুল, আপনার রব হইতে যাহা নাজেল করা হয়েছে তা পোউছাইয়া দেন। আর যদি তা না করেন তা হলে তাঁর (আল্লাহর) রেসালাত পৌছাইয়া দেওয়া হল না। আল্লাহ আপনাকে মানব মন্ডলী হতে লইয়া আসবেন। নিশ্চয় আল্লাহ কাফের দলকে হেদায়েত করেন না (সুরা মায়েদাঃ৬৭)। ইহা কোরানের সব শেষের আগের আয়াত। শেষ কথাটির প্রকৃত অনুবাদ হইলঃ আল্লাহ আপনাকে মনুষ্য হইতে (সরাইয়া) তাঁর সাথে লাগাইয়া লইতেছেন বা লইবেন।
“গাদির” অর্থ জলাশয়। জায়গার নাম খুম। খুমের জলাশয়ের নিকটবর্তী হইলে উক্ত আয়াত এইরুপে নাজেল হয়েছিলঃ “ইয়া আইউহার রাসুল বাল্লেগ মা উনজিলা ইলাইকা মির রাব্বেকা আন্না আলীউন মাওলাল মোমেনীন। অইন লাম্‌ তাফআল ফালা বাল্‌লাগতা রেসালাহু। আল্লাহু ইয়া, সেমুকা মিনান নাস”।
ইহা হতে “আন্না আলীউন মাওলাল মোমেনীন” কথাটি কোরান হতে বাদ দেয়া হয়েছিল ওসমানের (র) প্রকাশনা হতে। মুসা নবীর সঙ্গে যেমন হারুনের নাম কোরানে উল্লেখ করা হয়েছে, সেইরুপে আলী (আ) নামও কোরানে কয়েকবার ছিল। ( ইবনে আবি হাতেম বর্ননা করেছেন, আবু সাঈদ খুদরী হতে উক্ত আয়াত হযরত আলীর শানে নাজেল হয়েছে। ইবনে মারদুইয়া ইবনে ওমর হতে বর্ননা করেন যে, আমরা উক্ত আয়াত রসুলের (আ) এর সামনে এইভাবে পড়তামঃ তফসীরে দোররে মনসুর; মোল্লা জালালউদ্দিন শিউতী; ২য় খন্ড, মিশর থেকে প্রকাশিত)
[ উক্ত আয়াতের সমর্থনে হাদিস দু’টো হলো “মান কুন্তুম মাওলাহু ফাহাজা আলীউন মাওলাহু (বোখারী, মেশকাত)”। হযরত রাসুল (সাঃ) যে হযরত আলী (আঃ) কে হারুন নবীর সাথে তুলনা করেছেন তার প্রমাণ বোখারী ২য় খন্ড ১৯৪ পৃষ্ঠায় এবং ৩য় খন্ডে ৫২৬ পৃষ্ঠায় এবং ইবনে হিসাম ২৭৭ পৃষ্ঠায়। সা’দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রাঃ) হতে বর্নিত আছে যে, রসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ হে আলী, তুমি আমার নিকট ঐ স্থানে আছো যেখানে মুসার নিকট হারুন ছিল। কিন্তু আমি ব্যতীত নবী নেই আমি শেষ নবী। যদিও আরও অনেক প্রমাণ রয়েছে তবে আমি মনে করি জ্ঞানীদের জন্য এই দুটোই যথেষ্ট। ]
কিন্তু কথা হলো দীর্ঘ ২৩ বছর ইসলাম প্রচারের পরে, এত দুঃখ-কষ্ট সহ্য, যুদ্ধ-যন্ত্রনা সহ্য করার পরেও এমন কি জিনিস বাদ রয়ে গেল? যার জন্য রেসালাতই পুর্ন হবে না বলে আল্লাহ ঘোষনা করলেন?
এই আয়াত নাজেল হওয়ার সাথে সাথে রসুল পাক সেখানেই থামিয়া গেলেন এবং বাহন থেকে নেমে গেলেন। সবাইকে একত্র করলেন। সেখানকার “আকাশিয়া” নামক কাটা গাছগুলো পরিষ্কার করে ফেলা হলো। জোহরের নামাজ শেষে উটের গদিগুলো দিয়ে বেদী বা মঞ্চ করা হলো। যেহেতু দিনটি ছিল প্রচন্ড গরমের, সেহেতু বাবলা গাছের সাথে চাদর টানিয়ে রসুলুল্লাহ (সাঃ) এর জন্য ছায়ার ব্যবস্থা করা হলো। তারপর তিনি আল্লাহর প্রশংসা ও পবিত্রতা বর্ননা করলেন। আর বললেনঃ
“ নিশ্চয় আমি তোমাদের মধ্যে দুটি জিনিস আমানত রেখে যাচ্ছি, যদি এ দু’টিকে আঁকড়ে ধর তাহলে কখনো গোমড়াহ হবেনা। তার একটি হলো আল্লাহর কেতাব-যা আসমান হতে জমিন পর্যন্ত প্রসারিত রজ্জু এওবং অন্যটি হল আমার আহলে বায়াত। এ দুটি কখনো পরষ্পর বিচ্ছিন্ন হনে এবং এ অবস্থায়ই হাউজে কাউসার আমার সাথে মিলিত হবে। তাই লক্ষ্য রেখ তাদের সাথে তোমরা কিরুপ আচরন করবে” (তিরমিযী)
অন্য বর্ননায় উক্ত হাদিসের শেষে এ কথাটি রয়েছে যে, “আমি আমার আহলে বাইয়েত সম্পর্কে তোমাদেরকে আল্লাহর কথা স্মরণ করে দিচ্ছি”- এ কথাটি রাসুল (সাঃ) তিনবার করে বলেছিলেন। এ হাদিসটি তিরমিযী সুত্রে মেশকাতের ৫৮৯২ এবং ৫৮৯৩ নং হাদিসে সহী সুত্রে বর্নিত আছে হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ আনসারী (রাঃ) হতে এবং মুত্তাকী হিন্দী তাঁর “কানজুল উম্মাল” গ্রন্থে বর্ননা করেছেন। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ “আমি তোমাদেরকে অবশ্যই দুটি জিনিস নিয়ে জিজ্ঞাসা করব। আর তাহলো-কোরান ও আমার আহলে বায়াত। (আরবাইনাল আরবাইন এবং আল্লামা সিউতীর “ইহয়াউল মাইয়্যেত”)
তারপর রাসুলুল্লাহ (সাঃ) মিম্বরে দাঁড়িয়ে সকলের উদ্দেশ্যে বললেনঃ “আলাস্ত আওলা বেকুম মিন আনফুসিকুম” অর্থাৎ আমি কি তোমাদের আপন জীবন হতে অধিক প্রিয় নই? সবাই বললেনঃ “কালু বালা”-হ্যা ইয়া রসুলুল্লাহ(সাঃ)। সমবেত জনমন্ডলী হতে তিনবার এই সম্মতি নিবার পর রসুলুল্লাহ (সাঃ) হযরত আলী (আঃ) এর দু’বাহু সমবেত জনমন্ডলীর সামনে তুলে ধরলেন আর বললেনঃ
“মান কুন্তুম মাওলাহু ফাহাজাআলিউন মাওলাহু আল্লাহুম্মা ওয়ালে মান ওয়ালাহু, আদামান আদাহু, অন্সুর মান নাসারা অখ্‌জুল মান্‌ খাজালা, ফাল ইয়াছ হাদিল হাজেরুন খায়েরা”।
অর্থাৎ আমি যার মাওলা আলীও তার মাওলা। হে আল্লাহ! তুমি তাকে বন্ধু রুপে গ্রহণ কর যে তাকে বন্ধু রুপে গ্রহন করে, তাকে শত্রু রুপে গ্রহন কর যে তার সাথে শত্রুতা করে, এবং তাকে সাহায্য কর যে সাহায্য করে, এবং লাঞ্ছনা দাও তাকে যে লাঞ্ছনা দেয়।
এ হাদীসটি-“আহমদ” সূত্রে “মেশকাতের” ১৫৭ পৃষ্ঠায় ৫৮৪৪ নং হাদিসে বর্নিত আছে, হযরত বারা ইবনে আযেব ও যায়েদ ইবনে আরকাম (রাঃ) হতে। এ – হাদীসটির শেষে বর্ননাকারী বলেনঃ এরপর যখন হযরত আলী (আঃ) এর সাথে হযরত ওমর (রাঃ) এর সাক্ষাত হয়, তখন তিনি আলী (আঃ)-কে বললেনঃ
“ধন্যবাদ হে আবু তালিব পুত্র! তুমি সর্বময় প্রতিটি নারী-পুরুষের প্রশংসিত হয়ে রইল”।
“রেসালাত” মানে প্রতিনিধিত্ব। হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহপাকের প্রতিনিধি এবং তাঁর বিদায়ের পুর্বে হযরত আলী (আঃ) –কে তাঁর প্রতিনিধি করে যাবেন এ-ই ছিল আল্লাহ পাকের নির্দেশ। সদর উদ্দিন চিশতী সাহেব তাঁর “মাওলার অভিষেক” বইয়ের ১২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেনঃ “আলী (আঃ)-কে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব করার উপযুক্ত করে গড়ে তোলা হয়েছে। প্রতিনিধি হিসাবে আলী (আঃ)-কে জনমন্ডলীতে রসুল (সাঃ) এর পরে তাঁর স্থলাবিষিক্ত করার নির্দেশক সংবাদ নাজিল করা হয়েছিল এর কিছুকাল আগেই। তবে তিনি তা পরে সবার সামনে উপযুক্ত পরিবেশে প্রকাশ করলেন কেননা তিনি ভাল করেই জানতেন হযরত আলী (আঃ) এর এ মাওলাইয়াত বা প্রতিনিধিত্ব হিংসার বশবর্তী হয়ে লোকেরা অস্বীকার করবে এবং আলী (আঃ) এর বংশধরের বিরুদ্ধে গভীর চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র চলতে থাকবে যার ফলে ধর্ম বিনষ্ট হয়ে যাবে। তাই তিনি গাদীরে খুম নামক জায়গায় এসে জনসম্মুখে ইহা প্রকাশ করলেন; ইহার গুরুত্ব সবাইকে বোঝাবার জন্যই তিনি মক্কা থেকে ফেরার পথে “এহরাম বস্ত্র” পরিহিত অবস্থায় রওনা দিয়েছিলেন।
“গাদিরে খুমের” হাদিসটি “প্রতিনিধিত্ব” অর্থে প্রযোজ্য এবং এর পরেই উপস্থিত জনগন প্রতিনিধিত্ব স্বীকার করে বায়াত গ্রহন করেন। এ হাদিসটি “তাবরানী” ইবনে জরীর, হাকীম, তিরমিযী সবাই জায়েদ ইবনে আরকাম (রাঃ) হতে ঠিক এভাবেই হাদিসটির বিশুদ্ধতার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। এমনকি ইবনে হাজর তাঁর “সাওয়ায়েক” গ্রন্থের পঞ্চম পর্বের প্রথম অধ্যায়ের ২৫ পৃষ্ঠায় বর্ননা করে সহীহ হবার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। সামান্য বর্ননার ভিন্নতার মাধ্যমে গাদিরে খুমের ঘটনাটি “মুসনদে আহমদ, খাসায়েসুল আলাভীয়া” কিতাবেও বর্ননা করেছেন সহীহ্‌ হিসাবে। ঐতিহাসিক এ হাদিসটি কমপক্ষে ১১০ জন সাহাবা, ৮৪ জন তাবেঈন, ৩৫৫ জন উলামা, ২৫ জন ঐতিহাসিক, ২৭ জন সংগ্রাহক, ১১ জন ফিকাহ্‌বিদ, ১৮ জন ধর্মতাত্ত্বিক ও ৫জন ভাষাতাত্ত্বিক কতৃক বর্নিত হয়েছে।
কিছু কিছু লেখক “গাদিরে খুমের” সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে থাকেন, তাদের অজ্ঞতা এবং উত্তরাধিকার সুত্রে প্রাপ্ত প্রতিহিংসা হলো এর প্রধান কারণ। ইনারা মুনাফিক মুয়াবীয়া-ইয়াজিদ ও তাদের অনুসরণকারী মোল্লা মৌলবীদের ছিলছিলার প্রেতাত্বা বহন কারী কট্টর মৌলবাদ মুনাফিক। এজন্য তাদের কারো দ্বারা রচিত রসুলুল্লাহ (সাঃ) এর জীবনী কোন গ্রন্থে “গাদিরে খুমের” এ ঐতিহাসিক ঘটোনাটি পাওয়া যাবেনা। গাদিরে খুমের হাদিসটি – আল্লামা আল আমিনী তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ “আল গাদিরে” পুর্নতথ্যসহ বর্ননা করেছেন। এর জন্যই তিনি মৌলবাদী খারেজীদের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছিলেন। তবে যারা আল্লাহর রসুল (সাঃ) ও তাঁর প্রতিনীধি মাওলা আলী (আঃ)-কে মনে প্রানে মেনে নিতে পারেনি তারাই এই ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন তুলে। অথচ আল্লাহ বলেন নবী (সাঃ) কোন কাজ করেননা, কোন কথা বলেনা যতসময় না তাঁর আদেশ না আসে।
আল্লামা সৈয়দ সাঈদ আখতার রিজভী রচিত “ইমামত” বইয়ের ৩৭ পৃষ্ঠায় উক্ত গাদিরে খুমের ঘটনা ও হাদিস বর্ননাকারীগণের একটী তালিকা পেশ করেছেন তা দেখে নেয়া যেতে পারে।
গাদিরে খুমের ঘটনার একটি প্রমান হলো, ইমাম আহমদ তাঁর “মুসনদ” গ্রন্থে রিয়াহ ইবনে হারিস হতে দুটি সূত্রে বর্ননা করেছেনঃ
একদল লোক হযরত আলী (আঃ) এর নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, হে আমাদের মাওলা ! আপনার উপর ছালাম। হযরত আলী (আঃ) তাদেরকে প্রশ্ন করলেন তোমরা কারা? তারা বললঃ- হে আমিরুল মুমেনীন ! আমরা আপনার অনুগত ব্যক্তি। হযরত আলী (আঃ) বললেনঃ- আমি তোমাদের মাওলা কিরুপে হইলাম, তোমরাতো আরব! তারা বলল গাদিরের দিনে আমরা রসুল (সাঃ) কে বলতে শুনেছি- “আমি যার মাওলা এ আলীও তাঁর মাওলা”।
রিয়াহ বলেন, যখন তারা ফিরে যাচ্ছিল তখন আমি তাদের অনুসরণ করলাম এবং তাদের প্রশ্ন করলাম, আপনার কারা? তারা বলল, আমরা মদীনার আনসার। তাদের মধ্যে আবু আইয়ুব আনসারীও ছিলেন।
হাদিসটি মুতাওয়াতির হবার পক্ষে অপর দলিল হলো এ হাদিস আবু ইসহাক সালবী তাঁর তাফসীর গ্রন্থে সুরা মাআরিজের তফসীরে দুটি নির্ভরযোগ্য সুত্রে বর্ননা করেছেন। তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ (সাঃ) গাদিরের দিনে যখন জনগণকে সমবেত করে হযরত আলী (আঃ) এর হাত ধরে ঘোষনা করলেনঃ “মান কুন্তুম মাওলাহু ফাহাজা আলীউন মাওলাহু” – এ খবরটি তখন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। হারিস ইবনে নোমান ফিহরি তা শুনে উটে আরোহন করে রসুলুল্লাহ (সাঃ) এর নিকট এসে উটটি বেধে রাসুল (সাঃ) কে লক্ষ্য করে বললেনঃ হে মোহাম্মদ! তুমি একদিন নির্দেশ দিয়েছিলে এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস করতে এবং তোমাকে তাঁর নবী হিসাবে স্বীকার করতে, আমরা তা করেছি। পরবর্তীতে বললে, দিনে পাঁচবার নামাজ পড়তে তাও করলাম, যাকাত দাও- তাও দিলাম। পরে রমজান মাসে রোজার নির্দেশ দিলে তাও শুনলাম এবং হজ্জ্ব করার নির্দেশও পালন করলাম। এতো কিছুতেও তোমার সন্তুষ্টি হলো না, অবশেষে তোমার চাচাত ভাইয়ের হাত ধরে তাকে আমাদের উপর শ্রেষ্ট বলে ঘোষনা দিলে, “ আমি যার মাওলা, আলীও তার মাওলা”? – এ কথাটি কি তোমার নিজের পক্ষ থেকে নাকি আল্লাহর পক্ষ থেকে? নবী (সাঃ) বললেনঃ যিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নাই সেই আল্লাহর শপথ করে বলছি, ইহা আল্লাহর পক্ষ হতে। হারিস তার বাহনের দিকে ফিরে যেতে যেতে বললো, হে আল্লাহ ! মোহাম্মদ যা বলেছে তা যদি সত্য হয় তবে আমাদের উপর আসমান হতে পাথর বর্ষণ করুন অথবা আযাব প্রেরন করুন। তখনো সে বাহনের নিকট পৌছায়নি, আকাশ থেকে একটি ছোট পাথর তার মাথায় এসে পড়ল এবং পায়খানার রাস্তা দিয়ে বের হয়ে গেল এবং সেখানেই সে মারা গেল। এ ঘটনাটি মাওলানা ফারমান আলী স্বীয় তফসীরে সুরা মা’আরিজের ১-৩ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় উল্লেখ করেছেন। এবং আরো বহু কিতাবে এর ঘটনাটি বিশ্বস্থ সুত্রে বর্নিত আছে। আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের একদল হাদিসবেত্তা এ হাদিসটি বীনা বাক্যে গ্রহন করেছেন। যেমন – আল্লামা শাবলানজী মিশরী হতে তাঁর “নুরুল আবসার” গ্রন্থের ১১ পৃষ্ঠায় হযরত আলী (আঃ) এর জীবনীতে হাদিসটি সহীহ সুত্রে বর্ননা করেছেন। হালাবী তাঁর “সীরাহ” গ্রন্থের ৩য় খন্ডের ২১৪ পৃষ্ঠায় বিদায় হজ্জ্বের আলোচনায় হাদিসটি বর্ননা করেছেন এবং “আল মুরাজায়াত” কিতাবের ২৩৬ পৃষ্ঠায় এ হাদিস উল্লেখ আছে এবং ২৪২ পৃষ্ঠায় ঘটনা উল্লেখ আছে।
একদল নির্বোধ কট্টর মৌলবাদী খারেজীগণ বুঝাতে চেষ্টা করেন যে, রাসুল (সাঃ) তাঁর চাচাত ভাই আলী (আঃ)-কে যখন ইয়ামেনে প্রেরণ করেন তখন হযরত আলী (আঃ) এর বিরুদ্ধে একদল নিন্দুকেরা রাসুল রাসুল (সাঃ) এর কাছে অভিযোগ করেছিল। তাই নবী (সাঃ) , আলী (আঃ) সন্তুষ্টি করতে গাদিরে খুম নামক স্থানে এ হাদিসটি প্রকাশ করেন। বাস্তবে আজকেও আমার সামনে একজন এই কথা বলে বসলেনঃ “ আরে ভাই আলী তার চাচাতো ভাই তাই ...আমরাও যেমন আমাদের ছেলে মেয়ে ভাই বোনকে খুশি করতে বলে থাকি অনেক কিছু...সেইরকম তিনিও করেছেন। কিতু গর্ধবের দল এটূকু বুঝেনা, সামান্য খুশি করাবার জন্যে আল্লাহ তায়ালা একটা আয়াত নাজিল করবেন না, নবী (সাঃ) ও এত বড় অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা নিবেন না। আসলে কান্ডজ্ঞানহীন সাইনবোর্ডধারী খারেজী তাদের স্বার্থাম্বেষী, পরশ্রীকাতর মুনাফিকির দ্বারা সত্য বিষয়টিকে ধামাচাপা দিয়ে যাচ্ছে যুগে যুগে।
হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) বলেনঃ আমি আলী হতে, আলী আমা হতে। এ হাদিসটি সুনান লেখকদের মধ্যে নাসায়ী তাঁর “খাসায়েসুল আলাভীয়া” গ্রন্থে, আহমদ ইবনে হাম্বল তাঁর “মুসনাদের” ৪র্থ খন্ডে, হাকীম নিশাবুরী তাঁর “মুসতাদরাক” গ্রন্থের ৩য় খন্ডে, যাহাবী তাঁর “তালখিসে মুসতাদরাখ” গ্রন্থে বর্ননা করে বলেছেন যে, মুসলিমের শর্তানুযায়ী হাদিসটি সহীহ্‌। মুত্তাকী হিন্দী তাঁর “কানজুল উম্মাল” ৬ষ্ঠ খন্ডে ইবনে আবি শাউবাহ ও ইবনে জারীর হতে বর্ননা করেছেন এবং সহীহ বলে স্বীকার করেছেন।
হযরত ওমর (রাঃ) বায়াত গ্রহন করতে গিয়ে বললেনঃ ধন্যবাদ ধন্যবাদ হে আবু তালিবের পুত্র ! তুমি আজ হতে সকাল সন্ধ্যা মানে সর্বসময় প্রতিটি মুমীন নর-নারীর নিকট প্রশংসিত হয়ে রইলে। এ ঘটনাটি মেশকাতে ৫৮৪৪ নং হাদিসে বর্নিত আছে।
বায়াত সমাপ্ত শেষ হলে তখন কোরানের সর্বশেষ আয়াত নাজিল হয়ঃ
“ আল ইয়াওমা ইয়া ইসাল্লাযীনা...ইসলামা দ্বীনা (সুরা মায়েদাঃ ৩)”।
অর্থাৎ “আজ কাফের গন তোমাদের দ্বীন হতে নিরাশ হয়ে গিয়েছে। অতএব তাদেরকে আর ভয় করিও না, ভয় কর আমাকে। আজ তোমাদের দ্বীন পরিপুর্ন করে দিলাম এবং তোমাদের উপর আমার নেয়ামত পরিপুর্নতা দান করলাম এবং তোমাদের দ্বীন ইসলামের উপর আমি রাজি হলাম”।
এই আয়াতটি কোরানে নাজিল কৃত সর্বশেশ আয়াত। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) হযরত আলী (আঃ)-কে তাঁর প্রতিনীধি বা স্থলাভিষিক্ত করে ইসলামের পূর্নতা ঘোষনা করলেন।
আজ থেকে ১৪২৪ বছর আগে দশম হিজরির এই দিনে (১৮ ই জিলহজ) বিদায় হজ শেষে
সুরা মায়েদার ৬৭ নম্বর আয়াত নাজেল হওয়ার পর বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ
(সা.) তাঁর চাচাতো ভাই ও জামাতা আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী (আ.)-কে ‘গাদীর’
নামক স্থানে নিজের উত্তরসূরি বা স্থলাভিষিক্ত বলে ঘোষণা করেছিলেন।
এই দিনটি ঐতিহাসিক গাদীর দিবস বা ঈদে গাদীর হিসেবে খ্যাত। আজ সেই ঈদে গাদীর উপলক্ষে সবাইকে জানাচ্ছি ঈদ মুবারক।
সুরা মায়েদার ৬৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ এরশাদ করেছেন: "হে রসূল, পৌঁছে
দিন আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে। আর যদি
আপনি এরূপ না করেন, তবে আপনি তাঁর পয়গাম কিছুই পৌঁছালেন না। আল্লাহ আপনাকে
মানুষের কাছ থেকে রক্ষা করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ কাফেরদেরকে পথ প্রদর্শন
করেন না।"
গাদীরের ওই সমাবেশে এক লাখ বিশ হাজারেরও বেশি সাহাবি ও হজযাত্রী উপস্থিত ছিলেন।
'জুহফা' নামক এলাকার কাছে 'গাদিরে খুম' জলাশয়ের পাশে বিশ্বনবী (সা.)
ঘোষণা করেছিলেন যে " মান কুনতু মাওলা ফাহাজা আলিয়ুন মাওলা" অর্থাত আমি
যাদের মাওলা আলীও তাদের মাওলা বা নেতা।
ইমাম বোখারীসহ ৩৬০ জন সুন্নি মনীষী এ সংক্রান্ত হাদিস বর্ণনা করেছেন। এই
হাদিসটির সনদ ১১০ সাহাবি কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে এবং ২৬ জন মুসলিম মনীষী এর
সনদ ও পন্থা সম্পর্কে আলাদা বই রচনা করেছেন।
বিশ্বনবী (সা.) নিজের স্থলাভিষিক্ত হিসেবে আলী (আ.)'র মাথায় নিজের হাতে
তাঁর একটি পবিত্র পাগড়ী পরিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি গাদিরে খুমে তিন দিন অবস্থান
করেছিলেন। এই তিন দিন ধরে শীর্ষস্থানীয় সব সাহাবিগণসহ সব মুসলিম
নারী-পুরুষ পৃথকভাবে হযরত আলী (আ.)-কে আমিরুল মুমিনিন হিসেবে অভিনন্দন
জানিয়েছিলেন বলে নির্ভরযোগ্য সুন্নি বর্ণনায় এসেছে।
রাসূল (সা.) আরো বলেছেন: “এই আলী আমার ভাই, আমার ওয়াসি এবং আমার পর আমার
প্রতিনিধি হবে। তাই তাঁর আদেশ শোন, তাঁর আদেশ মত কাজ কর।” (তাফসিরে তাবারি,
১৯ খণ্ড, পৃ-১২১,
হযরত আলী সম্পর্কে নবী করিম (সা.) বলেছেন, আলী প্রেম মানুষের পাপ এমনভাবে
ধ্বংস করে যেমনি আগুন জ্বালানী কাঠ ধ্বংস করে দেয়। একবার হযরত আলী (আ.)-কে
দেখে আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছিলেন, তিনটি এমন বৈশিষ্ট্য তোমার রয়েছে
যেটা আমারও নেই, এই তিনটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তুমি এমন একজনকে শ্বশুর হিসেবে
পেয়েছে, যা আমি পাইনি, এমন একজনকে তুমি স্ত্রী হিসেবে পেয়েছে, যে কিনা
আমার কন্যা, আর তৃতীয়টি হচ্ছে তুমি হাসান- হুসাইনের মত সন্তানের পিতা যেটা
আমার নেই।
একবার বিশ্বনবী (সা.) কয়েকজন সাহাবির সঙ্গে ঘরে বসেছিলেন। সেখানে একটি
বিশেষ পাখীর মাংস খাবার হিসেবে আনা হয়েছিল। রাসূল (সা.) বললেন, হে আল্লাহ
তোমার সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তিকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিন। এমন সময় দরজায় টোকা
দিলেন আলী (আ.)। রাসূল (সা.) আলী (আ.)-কে নিয়ে সেই মাংস খান।
জাবের বিন আব্দুল্লাহ আনসারি বলেছেন, একবার রাসূল (সা.)-র কাছে আলী (আ.)
এলেন। রাসূল বললেন, আলী (আ.) ও তার অনুসারীরা কিয়ামতে পরিত্রাণপ্রাপ্ত।
মহানবী বলেন, ‘আগামীকাল আমি যুদ্ধের পতাকা এমন একজনের হাতে তুলে দেব যাঁকে আল্লাহ ও রসুল অত্যন্ত প্রিয়ভাজন মনে করেন। তাঁর হাতেই আমাদের বিজয় সুনিশ্চিত হবে’। হঠাৎ আমরা আলীকে দেখতে পেলাম। তখন সবাই বলে উঠল: তা হলে তিনি হলেন আলী। নবীজি আলীর হাতে পতাকা তুলে দিলেন। সে যুদ্ধে বিজয় অর্জিত হলো। (সহি বোখারী, হাদিস নং ৮৯৯)
আলী করমুল্লাহ বলেছেন, যিনি বীজ অঙ্কুরোদ্গম করেছেন ও মানুষ সৃষ্টি করেছেন তাঁর শপথ, নবী-রসুল আমাকে অসিয়ত করে বলেছেন যে, মোমিন আমাকে ভালবাসবে আর মোনাফেক আমাকে ঘৃণা করবে।(মুসলিম)
আবু বকর মোহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ, মোহাম্মদ বিন বশির, জাকারিয়া, মাসায়াব, সাফিয়া প্রমুখ থেকে রেওয়ায়েত করে আয়েশা বলেন, একদিন সকালে রসুলে করিম একটি কালো চাদরে আবৃত ছিলেন। এমন সময় সেখানে হাসান বিন আলী এলে নবীজি তাঁকে চাদরের মধ্যে টেনে নিলেন। তারপর সেখানে হোসাইন বিন আলী এলেন। নবী করিম তাঁকেও চাদরের মধ্যে নিলেন। তারপর ফাতেমা তুজ জোহরা এলেন। নবী করিম তাঁকেও চাদরের মধ্যে প্রবেশ করালেন। তারপর হযরত আলী এলেন। তাঁকেও নবী সেই চাদরের ভেতর টেনে নিলেন। যখন এই পাঁচজনই চাদরে আবৃত হলেন তখন রসুলে করিম বললেন, এ পাঁচজনই আমার আহলে বাইত অর্থাৎ আদর্শিক গৃহের অধিবাসী। (মুসলিম, ২য় খ-, পৃ.২৮৩)
নবী করিম আম্মার ইয়াসারকে বললেন, হে আম্মার, তুমি যদি আলীকে কোনও পথে চলতে দেখ, এবং অপরাপর সাহাবাদের ভিন্ন পথে চলতে দেখ (আলীর পথ ভিন্ন) মনে রেখ, তখন আলীর পথেই তোমরা যাবে ও অন্য সকলের অনুসৃত পথ পরিত্যাগ করবে। কেননা আলী তোমাদের কখনও ক্ষতিকর পথে নেবেন না এবং হেদায়েতের পথ ছাড়তে দেবেন না। (কাঞ্জুল উম্মাল, ৬ষ্ঠ খ-, পৃ.১৫৬)
আরও একবার নবীজি বলেছিলেন, হে আলী, আমার উম্মতদের মধ্যে সে অতিনিকৃষ্ট হতভাগা যে তোমাকে হত্যা করবে। (আল বেদায়া ও নেহায়া, ৭ম খ-, পৃ. ৩২৬)
হে আলী, খুব শীঘ্রই আমার দেহত্যাগের পর এই উম্মত তোমার প্রতি অবাধ্যতা প্রকাশ করবে। যেহেতু তুমি আমার পথ অনুসরণ করবে এবং আমার সুন্নত প্রচার করবে সেহেতু তোমাকে হত্যা করা হবে। হে আলী, যে তোমাকে ভালবাসে সে আমাকেও ভালবাসে। এবং যে তোমাকে হিংসা করবে সে আমাকেও হিংসা করবে। [অতঃপর আলীর মাথা ও চুলের দিকে তাকিয়ে বললেন] আর এই পবিত্র দাড়ি ও এই মাথা রক্তে রঞ্জিত হবে। (কাঞ্জুল উম্মাল, ২য় খ-, পৃ.১৫৭)
আমি আলীর প্রাণ, আলী আমার প্রাণ। (ইউনাবিল মোয়াদ্দা, ১ম খ-, পৃ.১৭৩)
হাদিসে এসেছে, রাসূল
(সা.) বলেছেন, আমি জ্ঞানের নগর আর আলী হল তার দরজা। অর্থাত বিশ্বনবী
(সা.)’র জ্ঞানের শহরে প্রবেশের জন্য আলী (আ.) নামক মাধ্যম বা দরজা দিয়েই
ঢুকতে হবে।
এ কারণেই মহান আল্লাহর নির্দেশে বিশ্বনবী (সা.) আলী
(আ.)-কে তাঁর উত্তরসূরি বা স্থলাভিষিক্ত তথা মুসলমানদের ইমাম বা নেতা বলে
ঘোষণা করেছিলেন পবিত্র গাদীর দিবসে। এই ইমামত হচ্ছে নবুওতেরই ধারাবাহিকতা।
তাবুকের যুদ্ধে: রাসূলুল্লাহ (স.) আলী (আ.) এর উদ্দেশে বলেন-
“[হে আলী!] তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, তুমি আমার কাছে ঠিক তদ্রূপ যেমন
হারুন (আ.) ছিলেন মুসা (আ.) এর কাছে। তবে পার্থক্য এই যে, আমার পরে আর কোনা
নবী নেই (আসবে না)।’
অর্থাৎ যেভাবে হারুন (আ.) কোনরকম ব্যবধান ছাড়াই মুসা (আ.) এর স্থলাভিষিক্ত ছিলেন তুমিও আমার খলিফা ও স্থলাভিষিক্ত।
দশম হিজরিতে: বিদায় হজ থেকে ফেরার পথে ‘গাদীরে খুম’ নামক স্থানে
হাজিদের এক বিশাল সমাবেশে মহানবী (স.) আলী (আ.) কে মুসলমান ও মু’মিনদের
নেতা হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন।
তিনি বলেন-
“আমি যার মাওলা (অভিভাবক) আলীও তার মাওলা।” এই বাক্যটি তিনি তিনবার
পুনরাবৃত্তি করেছিলেন। এরপর বললেন:- “হে আল্লাহ! তাকে তুমি ভালবাসত যে
আলীকে ভালবাসে ও তুমি তার প্রতি শত্রুতা পোষণ কর যে আলীর প্রতি শত্রুতা
পোষণ করে; তুমি সহযোগিতা কর তাকে যে আলীকে সহযোগিতা করে, তুমি তাকে নিঃসঙ্গ
কর যে আলীকে একা রাখে এবং সত্যকে আলীর সাথে রাখ তা যে দিকেই থাক না কেন”।
হে লোকসকল! আপনারা অবশ্যই যারা উপস্থিত আছেন তারা এই বাণীটি অনুপস্থিতদের
নিকট পৌঁছিয়ে দিবেন। রাসূলের (সা.) বক্তব্য শেষ হলে জিবরাঈল (আ.) আবার
দ্বিতীয়বারের মত অবতীর্ণ হয়ে তাঁকে এই বাণীটি পৌঁছে দেন:
আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করলাম ও আমার নেয়ামত বা অবদানকে তোমাদের
উপর সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের ধর্ম হিসেবে মনোনীত করলাম। (সূরা
মায়িদা-৩)
রাসূল (সা.) এই বাণী পেয়ে মহা-আনন্দিত হলেন এবং বললেন- মহান আল্লাহর শুকর
করছি যে তিনি দ্বীনকে পরিপূর্ণ ও তাঁর নেয়ামতকে সম্পূর্ণ করেছেন এবং মহান
প্রভু আমার রেসালাতের বা নবুওতি দায়িত্বের ও আলীর বেলায়াতের বা
অভিভাবকত্বের উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন।
মুষ্টিমেয় সংখ্যক লোক ছাড়া কেউ আলীর মর্যাদা তথা আল্লাহর বন্ধুত্ব রক্ষা করে না। সেকথা মহানবী আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বে বলে গেছেন, আলীর বিরোধিতাই ইসলামের প্রথম ভাঙন। (ইউনাবিল মোয়াদ্দা, ২য় খন্ড, পৃ.৩১৩)
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- আল্লাহর রাসূল (স.) তাঁর বক্তব্যের শুরুতে
বলেছিলেন: “আমি কি তোমাদের ওপর তোমাদের নিজেদের চেয়ে শ্রেষ্ঠত্ব রাখি না?”
তখন উপস্থিত সব মুসলমান দাঁড়িয়ে রাসূল (স.) এর এ কথার প্রতি সম্মতি জানান।
অতএব, বিষয়টি হতে স্পষ্ট হয় যে, এই হাদিসে 'মাওলা' বলতে মু’মিনদের ওপর
শ্রেষ্ঠত্ব ও তাদের পূর্ণ কর্তৃত্বকে বোঝানো হয়েছে। অতএব, এটা স্পষ্ট যে,
আল্লাহর রাসূল (স.) যে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী ছিলেন উম্মতের ক্ষেত্রে তা
তিনি আলী(আ.) এর জন্যও নিশ্চিত করে যান।
হযরত মুহাম্মাদ (সা.) -“‘মান কুনতু মাওলা ফাহাজা
আলিয়ুন মাওলা’ অর্থাৎ আমি যাদের মাওলা
আলীও তাদের মাওলা বা নেতা”-
কথাটি বলার পর ঐ স্থানে তিন দিন অবস্থান করেছিলেন। এর করণ ছিল, তখন সকলের নিকট হতে বাইয়াত
গ্রহণ করেছিলে। উপস্থিত সকল নারী ও পুরুষের নিকট হতে।
মোহাম্মদী ইসলামের সূচনাকাল থেকে আলী মহানবীর সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে ছিলেন। হেরাগুহা থেকে আরম্ভ করে প্রতিকূলতাময় জলে স্থলে রণাঙ্গনে সর্বত্রই তিনি ছিলেন নবীজির সবচেয়ে বিশ্বস্ত সহকারী।
নবী নিজেই বলেছেন, আলী কোরানের সাথে, কোরান আলীর সাথে। (নূর উল আবসার, পৃ. ৮৯)
আমার পর আলী মোমিনদের অভিবাবক। (তিরমিজি, ৫ম খ-, পৃ.৬৩২)
আলী মোমিনদের মেরুদণ্ড। (কাঞ্জুল উম্মাল, ১২তম খ-, পৃ. ২০৪, হাদিস নং ১১৫৮)
আলী হলেন জাহান্নাম ও জান্নাতের বন্টনকারী। (ইউনাবিল মোয়াদ্দা, ১ম খ-, পৃ.১৬৩)
আলী অর্থ সর্বোচ্চ। আল্লা’র অপর এক নাম আলী।
## আলীর তুলনা ভাষার তুলিতে কখনও যায় কি আঁকা
##
অসীম সাগর কলসির মাঝে কখনও যায় না রাখা
# #
আল্লাহ তাআলা তাঁর "কুদরত" প্রকাশ করেছেন।
"অামিন"

রক্তাক্ত পঁচাত্তর: ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ!

‘সেদিনের কথা স্পষ্ট মনে আছে আমার। খুব ভোরে আমাদের ঘুমে থেকে ডেকে তুললেন বাবা। তাকে খুব ব্যথিত দেখাচ্ছিলো। কান্নাভেজা গলায় বললেন -ওরা শেখ মুজিবকে মেরে ফেলেছে’। মুনতাসীর মামুনকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে অনেকটা এরকমই ছিল বেনজীর ভুট্টোর স্মৃতিচারণ।

১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট দীর্ঘপ্রতিদ্বন্দ্বির মৃত্যুর খবরে মেয়ের চোখে এমন প্রতিক্রিয়াই ছিল জুলফিকার আলী ভুট্টোর। কিন্তু ইতিহাস ভিন্ন সাক্ষ্য দিচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের খবরটা ভুট্টোর কাছে প্রত্যাশিত ছিল, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তার কাছে পৌঁছে যায় তা। নতুন প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদের সরকারকে সবার আগে স্বীকৃতি দেয় পাকিস্তান। স্বীকৃতির সঙ্গে নজরানাও ছিল। অত্যন্ত খুশীর সংবাদে যেমন দেয় তার মতো সামন্তপ্রভুরা। ৫০ হাজার টন চাল, প্রচুর থানকাপড় এবং অন্যান্য উপহার সামগ্রী নিয়ে ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশে’ এর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেওয়ার প্রস্তুতি নেয় পাকিস্তানি জাহাজ সাফিনা-ই-ইসমাইল।

ভুট্টোর খুশি ডাবল হওয়ার কারণ ছিল। ১৫ অগাস্ট নির্মম সে হত্যাকাণ্ড শেষে বাংলাদেশের সুন্নতে খাতনাটাও সেরে ফেলে খুনির দল। রক্তাক্ত সে ভোরে ইথারে ভেসে আসে:

আমি মেজর ডালিম বলছি। স্বৈরাচারি শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। জননেতা খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে। দেশে সামরিক আইন জারি করা হয়েছে এবং সারাদেশে কারফিউ জারি করা হয়েছে। বাংলাদেশ এখন থেকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র।

ভুট্টোর মনে পড়ে যাওয়ার কথা চার বছর আগের সেই জনসভা। না হয় একটু খুন-জখম হয়েছে। তাই বলে মুসলমান একটা দেশকে আলাদা হয়ে যেতে হবে! তাও জন্মশত্রু ভারতের কোলে চেপে! হিন্দুদের দালাল মুজিবের ধর্মনিরপেক্ষতার বড়ি গেলা স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের উদ্দেশ্যে শুনিয়েছিলেন তার সেই অমর বাণী: শুয়োরকে বাচ্চে, জাহান্নামমে যাও…। সেই ‘শুয়োরের বাচ্চাদের’ এখন বুকে তুলে নিতে বাধা নেই, হাজার হোক ‘মুসলমান’ ‘মুসলমান’ ভাই ভাই।

উপরের কথাগুলো যাদের কাছে শ্লেষাত্মক মনে হচ্ছে, তাদের সবিনয়ে জানাই যে শুধু ভুট্টোই নয়, গোটা পাকিস্তানে মুজিব হত্যার প্রতিক্রিয়া ছিল ঠিক এরকম। ১৫ আগস্ট রাতে পাকিস্তান সরকারের পাঠানো আনুষ্ঠানিক বিবৃতিটি সেদেশের পত্রিকাগুলোয় পৌছে, তাতে শেখ মুজিবের হত্যায় শোকও প্রকাশ করা হয়। আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে পাকিস্তানের বিভক্তির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাতে উল্লিখিত উপহারের ঘোষণা দেওয়া হয় এবং ইসলামী প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়। বিবৃতিতে ভুট্টোর উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়:

As a first and spontaneous gesture to the fraternal people of Bangladesh, I have decided to immediately dispatch to Bangladesh as a gift from the people of Pakistan 50,000 tons of rice, 10 million yards of long cloth and five million yards of bleached mull. This is only a modest contribution of our people to our brothers in Bangladesh in their hour of need. We are prepared to make a greater contribution within our greater capacity for the well being of the people of Bangladesh with whom we have shared common nationhood and destiny. Let the world know that we stand together in weal and woe. We respectfully urge the state members of the Islamic conference to accord recognition to the new government of the Islamic Republic of Bangladesh and we appeal to all countries of the third world to do likewise. This appeal stems from our anguished awareness of how our country has dismembered by an international conspiracy culminating in aggression. I grieve that Sheikh Mujibur Rahman and members of his family have met a tragic end.

মাসচারেক আগে পাকিস্তান থেকে আরেকটি শোকবার্তা গিয়েছিল বাংলাদেশে, খোদ বঙ্গবন্ধুর কাছে। শেখ মুজিবের পিতার মৃত্যুতে ভুট্টো সান্তনা জানিয়েছিলেন।

স্বীকৃতির পাশাপাশি খন্দকার মোশতাকের কাছে একটি ব্যক্তিগত বার্তাও পাঠান ভুট্টো। তাতে সামরিক অভ্যুত্থানের নামে সেই হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব যদি হুমকির মুখে পড়ে তাহলে সর্বশক্তি দিয়ে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি ছিল। ভুট্টো লেখেন:

Pakistan will resolutely undertake efforts to uphold and defend the political independence, the state sovereignty and territorial integrity of Bangladesh.

এবার দেখা যাক পাকিস্তানের জনগণ কিভাবে নিয়েছিল খবরটা। ২০ অগাস্ট ইসলামাবাদের মার্কিন দুতাবাস থেকে পাঠানো তারবার্তায় লেখা হয় :

News of the murder of Mujib was received with satisfaction by press and many Pakistanis, only a few intellectuals seemed to regret the violent manner in which he was removed, but not the results. Mujib was widely characterized as a traitor to Pakistan and Islam whose establishment of a dictatorship was the immediate cause of his downfall and who had died as a traitor and dictator should.

সেখানে জামাতে ইসলামীর আধ্যাত্মিক নেতা মাওলানা মওদুদীর প্রতিক্রিয়ায় ঘটনাকে ‘আল্লাহর আশীর্বাদ এবং ইসলামের বিজয়’ বলে উল্লেখ করা হয়। উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে পাকিস্তানি জনগণ মনে করে, মুজিব হত্যায় ভুট্টোর হাত আছে এবং ভুট্টোও ঠারেঠোরে তা বুঝিয়ে দেন।

ওই বার্তায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি ছিল বাংলাদেশের ইসলামী প্রজাতন্ত্র বিষয়ক সংশয়। ভুট্টো আগ বাড়িয়ে তার বিবৃতিতে বাংলাদেশকে ‘ইসলামিক রিপাবলিক’ বলে উল্লেখ করলেও তার আড়াইদিন পরও বাংলাদেশ সরকার তরফে এমন কোনো ঘোষণা আসেনি। বড় মুখ করে বিভিন্ন ইসলামী দেশগুলোর স্বীকৃতি আদায়ে তার দূতিয়ালিও এই প্রেক্ষিতে খানিকটা হোঁচট খায়। অন্যভাবে বললে- ব্যাপারটা ব্যক্তিগত অপমান হিসেবে নেন তিনি। প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে বাংলাদেশ রেডিও এবং বিভিন্ন বার্তাসংস্থার টিকার সার্ভিসই (গুরুত্বপূর্ণ সংবাদের সংক্ষিপ্ত রূপ) ছিল পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের খবর জানার একমাত্র মাধ্যম। মেজর ডালিমের প্রথম ঘোষণা এবং বার্তাসংস্থা এএফপি ও রয়টার্সের তা হুবহু পরিবেশনকেই ভুট্টো তার ওই সম্বোধনের কারণ বলে উল্লেখ করেছেন পরে। নেপথ্যের সত্যিটা পরের পোস্টে পরিষ্কার হয়ে যাবে, সেখানে বোঝা যাবে ভুট্টো আদৌ ভুল করে বলেছেন, নাকি চুক্তিটা সেরকমই হয়েছিল।

১৫ অগাস্টের হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের একটা বড় অভিযোগ ছিল মুজিব ছিলেন রুশ-ভারতের দালাল। ৬ অগাস্ট ঢাকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত ইউজিন বোস্টারের সঙ্গে আলাপে মুজিব অবশ্য ডিফেন্ড করেছিলেন নিজেকে । বলেছিলেন :

আমি মার্ক্সিস্ট না, আমি একজন সমাজতন্ত্রী তবে আমার নিজস্ব ধরনের সমাজতন্ত্রী। আমি সব দেশের সঙ্গেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চাই, কিন্তু কোনো দেশ যদি আশা করে আমি তাদের নির্দেশমতো চলবো সেটা হবে ভুল। আমি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া দুইদেশেরই খুব ভালো বন্ধু হতে চাই। কিন্তু আমি রাশিয়া বা আমেরিকার দালাল হতে চাই না।

হত্যাকাণ্ডের পর ভারত ও সোভিয়েত আগ্রাসনবাদ থেকে বাংলাদেশ উদ্ধার পেয়েছে এমন একটা মতবাদের পক্ষে প্রচারণা তাই জোরালো ছিল। আর এই অক্ষ পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন ছিলো মার্কিন-চীন এবং ইসলামী দেশগুলোর জোরালো সমর্থন। মোশতাক ঠিক সেকথাই বলেছিলেন রাষ্ট্রপতি হিসেবে বোস্টারের সঙ্গে তার প্রথম বৈঠকে। ২০ অগাস্টের তারবার্তায় বোস্টারের বরাতে লেখা হয়েছে।

উনি বললেন এখনও তার চাহিদামতো কোনো এজেন্ডা তৈরি না হলেও ১৯৭১ সালে হারানো সুযোগটা আজ নষ্ট করা উচিত হবে না। প্রসঙ্গটা উনি মে মাসে আমাদের দুজনের এক সাক্ষাতকারে একবার উল্লেখ করেছিলেন যে কলকাতায় মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে একটা সমঝোতার উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত যা ফলপ্রসূ হয়নি।

সাক্ষাৎকারের ব্যাপারগুলো পরের পোস্টে আলোচনা করা যাবে। তবে মোশতাক ও ভুট্টোর দুজনেরই উদ্যোগ এবং তৎপরতায় এটা স্পষ্ট ছিল যে তারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের শেষ পর্বটা নতুন করে লিখতে চাচ্ছিলো। মুক্তিযুদ্ধের দুই মিত্র ভারত এবং রাশিয়া এবার প্রতিপক্ষ হবে। সৌদিআরব-চীন এবং মার্কিন সহায়তায় আবার একজোট হয়ে যাবে দুই পাকিস্তান।

এই পর্যায়ে এসে ইসলামী প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ একটা দারুণ সহায় হলেও, শেষ পর্যন্ত তা ঝামেলা হয়ে দাঁড়ায় নানা বিবেচনায়। প্রথমত, ভারত এ ব্যাপারে তাদের আপত্তি জানিয়ে দেয় স্পষ্টভাবেই। মুজিব হত্যাকাণ্ডসহ রাজনৈতিক পটপরিবর্তনকে তারা কূটনৈতিক ভাষায় ‘বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ সমস্যা’ বলে মেনে নিতে রাজি। কিন্তু নতুন সরকারের কোনো সাম্প্রদায়িক মনোভাবের কারণে সীমান্তে আবারও শরণার্থীর ঢল নামলে তারা বসে থাকবে না। ঘটনার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পাকিস্তানের স্বীকৃতি এবং ত্রাণসহায়তা পাঠানোর ব্যাপারটা সন্দেহজনক বলে জানায় তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। 

মোশতাকের টনক নড়ে, ভারতকে যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে নিশ্চয়তা দেওয়া হয় নাম পরিবর্তনের ব্যাপারটি ঘটবে না। তবে মোশতাক যে অসহায় নন তার প্রমাণও পায় ভারত। সীমান্ত জুড়ে চীনের রণসজ্জা তাদের নতুন করে ভাবতে বাধ্য করায় যে বাংলাদেশ আক্রমণ করলে যুদ্ধটা অনেকগুলো ফ্রন্টে ছড়িয়ে যাবে। ২০ এপ্রিলের সিকিম অভ্যুত্থান কিংবা তামিলল্যান্ডে ভারতীয় সেনাদের উপস্থিতির পুনরাবৃত্তি থেকে তাই নিশ্চিত থাকে ঢাকা। অবশ্য মোশতাক সরকারকে স্বীকৃতি দিতে খুব বেশি সময় নেয়নি ভারতও। মোশতাক অবশ্য ইতিমধ্যে কিছু পরিবর্তন এনেছেন। বক্তৃতায় ‘জয় বাংলা’র বদলে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ দিয়ে যার শুরু। বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ নিষিদ্ধ এবং তার ছবি সব জায়গা থেকে সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়। তার সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে টুপিকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় পোশাকের অংশ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া।

রাষ্ট্রীয় পোশাক নির্ধারিত হয় তার সবসময়কার পরিধেয় আচকান এবং শেরওয়ানি । ৬ অক্টোবর মন্ত্রীপরিষদে এ ঘোষণা দেওয়ার আগে নিজের মাথার টুপিটাকে টেবিলে নামিয়ে সেটার দিকে আঙুল তুলে তার মনোভাব জানান তিনি। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা ছিল- চট্টগ্রাম বন্দরে মাইন সরানোর কাজে নিয়োজিত সোভিয়েত নৌবাহিনীর সঙ্গে চুক্তি নবায়নে অস্বীকৃতি। আগের বছরই চুক্তি শেষ হয়ে গেলেও তখনও তারা চট্টগ্রাম বন্দর ছেড়ে যায়নি, মোশতাক তাদের যেতে বাধ্য করলেন।

২৬ আগস্ট ভুট্টোকে পাঠানো তার চিঠি প্রকাশিত হয় পাকিস্তানের পত্রপত্রিকায় । ভুট্টোর ইসলামী প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সম্বোধনের জবাবে মোশতাক গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপতি হিসেবেই নিজেকে উল্লেখ করেছেন। তবে ঘাটতিটা পুষিয়ে দিয়েছেন ইসলামী সম্বোধনে। ‘আসসালামু আলাইকুম’ দিয়ে শুরু সে চিঠিতে পাকিস্তানের সঙ্গে আবার আগের মতো সম্পর্ক স্থাপনে বাংলাদেশের জনগণ যে মুখিয়ে আছে এমন মনোভাব দেখান মোশতাক। লিখেন:

ASSALAM-O-ALAIKUM:

YOUR EXCELLENCY, I HAVE THE HONOUR TO ACKNOWLEDGE RECEIPT OF YOUR EXCELLENCY’S MESSAGE CONVEYED BY THE EMBASSY OF SWITZERLAND ON AUG. 18, 1975, AS WELL AS THE MESSAGE RECEIVED THROUGH YOUR AMBASSADOR IN RANGOON. “MAY I, ON BEHALF OF THE GOVERNMENT AND PEOPLE OF BANGLADESH, GRATEFULLY ACKNOWLEDGE THE GESTURES SO SPONTANEOUSLY MADE BY THE GOVERNMENT AND PEOPLE OF PAKISTAN.

THE GOVERNMENT AND PEOPLE OF THE PEOPLE’S REPUBLIC OF BANGLADESH LOOK FORWARD WITH CONFIDENCE TO THE EARLIEST OPENING OF A NEW CHAPTER BETWEEN OUR TWO COUNTRIES, THE NORMALIZATION OF RELATIONS AND THE FORGING OF FRIENDLY AND BROTHERLY TIES BETWEEN US.”IN THE END, EXCELLENCY, I WOULD LIKE TO TRANSMIT GREETINGS FROM THE PEOPLE AND GOVERNMENT OF THE PEOPLE’S REPUBLIC OF BANGLADESH TO THE PEOPLE AND GOVERNMENT OF THE ISLAMIC REPUBLIC OF PAKISTAN.

মজার ব্যাপার হচ্ছে ঢাকা থেকে রেডিওতে এই চিঠিপত্র চালাচালির ব্যাপারে বেশ রাখঢাক রেখে খবর প্রচার করা হয়। বলা হয়, সম্পর্কোন্নয়নে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে কূটনৈতিক পর্যায়ে যোগাযোগ হয়েছে। ভুট্টোর বার্তার ব্যাপারে জানানো হলেও উপঢৌকনের কথা চেপে যাওয়া হয়।

চমকপ্রদ ঠেকতে পারে যে, মোশতাক বাকশাল বাতিলসহ শেখ মুজিবের গৃহীত প্রচুর নীতিতে পরিবর্তন আনলেও মুক্তিযুদ্ধের চার চেতনায় হাত দেননি, কিংবা বলা যায় দেওয়ার সাহস পাননি । খুনিদের সুরক্ষার জন্য ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ প্রণয়ন, স্বাধীনতাবিরোধীদের মুক্তি দিতে দালাল আইন বাতিলসহ ভুট্টোকে খুশি করার জন্য তার পদক্ষেপ কম ছিল না। ভুট্টো ধৈর্য ধরতে রাজি হলেন। হুট করে কিছু না করে নতুন সরকারকে থিতু হওয়ার সুযোগ দেওয়াটাকে তার কাছে যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হলো। আপাতত জাহাজ কূটনীতি এবং দুই দেশের দূতাবাস স্থাপনের মাধ্যমে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনকে অগ্রাধিকার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।

এই জাহাজ কূটনীতি প্রসঙ্গে একটা ঘটনা উল্লেখ না করলেই নয়। ১৯৭৩ সালে মুজিব খাদ্য সংকট সমাধানে তৃতীয় মাধ্যমে পাকিস্তান থেকে চাল কিনেছিলেন। ১৩মে মাদ্রাজ উপকুলে ৯ হাজার ৮০০ টন চালসহ ডুবে যায় গ্রিক জাহাজ স্পাইরোস। ২২মে জানা যায়- ব্যাপারটা ছিল অন্তর্ঘাত এবং এতে জাহাজের দুই পাকিস্তানি ক্রু জড়িত। দেশে কৃত্রিম খাদ্যসংকট সৃষ্টি করার ষড়যন্ত্রের জন্য পাকিস্তানকে সেবার কূটনৈতিকভাবে অভিযুক্ত করেছিল ঢাকা। পাকিস্তানের জন্য বিব্রতকর ছিল ৭৪ সালের ঘটনাটি। বাংলাদেশের বন্যাদুর্গতদের জন্য ৫ হাজার ৫০০টন চাল ও ৮৯০টন কাপড় পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন ভুট্টো। কিন্তু দ্বিপক্ষীয় আলোচনাকে প্রভাবিত করার ফন্দি বলে সন্দেহ করে প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করেন মুজিব।

সেপ্টেম্বরের শুরুতে মধ্যপ্রাচ্য সফরে ভুট্টোকে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে সৌদি আরব অভিযোগ করে , শুরুতে বললেও বাংলাদেশ এখনও নিজেকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র বলে ঘোষণা করেনি। এ ব্যাপারে বিভিন্ন মুসলিম দেশ, এমনকি পাকিস্তান থেকেও (বলা উচিত যে গোলাম আযমসহ জামায়াতে ইসলামীর অনেক নেতাই তখন সৌদি বাদশার আতিথ্যে, তাদের নাগরিকত্ব তখনও পাকিস্তানি) ‘ধর্মপ্রাণ মুসলমান’রা অভিযোগ এনেছে। তাই তারা স্বীকৃতি প্রত্যাহারের কথা ভাবছেন।

জবাবে পাকিস্তানি তরফে বলা হয়, যে ঢাকা অভ্যুত্থানে ধর্মনিরপেক্ষতাপন্থি, ভারতপন্থি এবং ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিভক্তির পক্ষের শক্তিতে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা হয়েছে। ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তাকে মাথায় রেখেও বলা যায় যে, বাংলাদেশ সরকার ধীরে ধীরে এমন পদক্ষেপ নিচ্ছে যা ভবিষ্যতে পাকিস্তান এবং সৌদি আরবের পক্ষেই যাবে। বাংলাদেশ যে ভারতের চাপেই ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্র’ হিসেবে নিজেকে ঘোষণা দিতে পারেনি এমনটাও জানায় পাকিস্তান। এরপর সৌদি আরব রাজি হয় স্বীকৃতি প্রত্যাহার না করতে।

দু্ইদেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের ঘোষণা আসে ৪ অক্টোবর । নিউইয়র্কে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবু সাঈদ চৌধুরী এবং পাকিস্তানের মূখ্যমন্ত্রী আজিজ আহমদের মধ্যে অনেকগুলো বৈঠকের পর এ ঘোষণা আসে। এতে দুই দেশের মধ্যে দুতাবাস স্থাপনের মাধ্যমে সম্পর্কোন্নয়নে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয়। একইদিন ইসলামাবাদ থেকে পাঠানো তারবার্তায় বাড়তি কিছু খবর ছিল। এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে ইসলামাবাদে একজন মন্ত্রীকে তার প্রতিনিধি হিসেবে পাঠিয়েছিলেন মোশতাক। এছাড়া করাচির এক পত্রিকায় বাংলাদেশ-পাকিস্তানের জোট (কনফেডারেশন) আসন্ন এমন এক খবরে সোভিয়েত রাষ্ট্রদূতের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার কথাও জানা যায়। আগের রাতে পবিত্র শব-ই ক্দর উপলক্ষ্যে এক ভাষণেও মোশতাক একই ঘোষণা দেন। সে ঘোষণায় পরের বছর অর্থাৎ ’৭৬ সালের ১৫ অগাস্ট রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত জানান তিনি। সব ধরনের রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দেওয়ার পাশাপাশি ১৯৭৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণাও দেওয়া হয়।

এর আগে ৩ সেপ্টেম্বরের এক তারবার্তায় পাকিস্তানের বন্যা দুর্গত অঞ্চলে বাংলাদেশ সরকারের একটি মেডিকেল টিম পাঠানোর খবর জানা যায়, বন্যার খবরে মোশতাকের উদ্বেগও জানানো হয়। পাকিস্তান মেডিকেল টিমকে অপ্রয়োজনীয় মনে করলেও শুভেচ্ছাদূত হিসেবে তাদের গ্রহণ করতে সম্মতির কথা জানায়। একই তারবার্তায় ভুট্টোর ঘোষিত উপহার সম্পর্কে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা হায়াত মেহেদি জানান, উপহারের জোগাড়যন্ত্র চলছে। তবে বাংলাদেশ সরকার এই উপহার গ্রহণ করবে কিনা এ ব্যাপারে চূড়ান্ত কোনো সম্মতি তাদের তরফে এখনও আসেনি।

২৩ সেপ্টেম্বরের তারবার্তায় জানা গেছে, উপহারের প্রথমভাগ জাহাজে ওঠানো হয়েছে এবং সপ্তাহখানেকের মধ্যেই তা চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে। সব ঠিকঠাক থাকলে ৭ অক্টোবর তা সেখানে পৌঁছাবে। ১ অক্টোবর পাঠানো তারবার্তায় সেদিনের পাকিস্তানি পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, ১০ হাজার ২২০টন চাল এবং ২৩৬টন চাল নিয়ে সাফিনা-ই-ইসমাইল নামের জাহাজটি আগেরদিন চট্টগ্রাম রওয়ানা হয়েছে। এটি ১১ অক্টোবর পৌঁছাবে।

ভুট্টোর প্রতিশ্রুত বাকি উপহার নভেম্বরের মধ্যেই আরো তিন-চারটি জাহাজে বাংলাদেশে পৌঁছে যাবে। ১৯৭১ সালের পর এটি বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় পাকিস্তানের প্রথম জাহাজ। এ ব্যাপারে পাকিস্তানের এক কর্মকর্তাকে মার্কিন দূতাবাস থেকে মজা করে জিজ্ঞেস করা হয় যে, জাহাজটা আটক করে বাংলাদেশ এটা নিজেদের সম্পত্তি বলে দাবি করার সম্ভাবনা কতটুকু। উত্তর আসে যে, আগে হলে সম্ভাবনা ছিল, এখন নতুন সরকার।

নভেম্বরের সেনাঅভুথ্যানের সময়টা প্রত্যাশিত উদ্বেগে কেটেছে পাকিস্তান সরকারের। এ ব্যাপারে ৮ নভেম্বর মার্কিন দূতাবাসের পাঠানো তারবার্তায় জেনারেল জিয়াউর রহমানের স্বপদে ফিরে আসায় স্বস্তির আভাসে মিলেছে ভুট্টোর তরফে। খালেদ মোশাররফের অভ্যুথানে যে ভারতের হাত ছিল না সেটা তিনি অবিশ্বাস করেননি। তবে খালেদের ব্যাপারে পাকিস্তানিদের অস্বস্তিটা ছিল পরিষ্কার কারণ তাদের পররাষ্ট্রদপ্তরের চোখে তিনি রাজনৈতিক ভাবমূর্তির একজন জেনারেল, যা পেশাদার জিয়ার সম্পূর্ণ বিপরীত। বিচারপতি সায়েমকে প্রধান সামরিক আইনপ্রশাসক রেখে জিয়াকে তার অধীনস্ত করার সম্ভাব্য কারণটি জানতে চান ভুট্টো। রাষ্ট্রদূত বাইরোড উত্তরে বলেন, একজন বেসামরিক বিচারপতির অধীনে সামরিক বাহিনীর থাকাটা আগামী দিনগুলোর জন্য কম ঝুঁকিপূর্ণ। সংঘাতটা আগামীতে আরো বাড়তে পারে কিনা ভুট্টোর এই আশঙ্কার জবাবে বাইরোডের মন্তব্য বেশ তাৎপর্যপূর্ণ: তেমন কোনো সম্ভাবনার খবর এখনও আমরা পাইনি। নৌ এবং বিমান বাহিনী রহমানের (জিয়া) এবং সেনাবাহিনীর সঙ্গেই আছে, আর মুক্তিবাহিনীর (!) অবস্থা ছিন্নভিন্ন, তারা সামরিক বাহিনীর অধীনেই আছে।

ঢাকার বাইরে সেনানিবাসগুলোতে খালেদ মোশাররফের প্রতি অনুগত বা তার মৃত্যুতে ক্ষুব্ধ এমন কোনও সেনা ইউনিট আছে কিনা জানতে চাওয়া হলে বাইরোড ভুট্টোকে নিশ্চিন্ত করে বলেন- তেমন কোনো খবর এখনও আমরা পাইনি।

তবে ভুট্টোর স্বপ্নটা জিয়ার হাতেও পূর্ণতা পায়নি। ইসলামী প্রজাতন্ত্র বিষয়ে কোনো ঘোষণা তিনিও দেননি। এ ব্যাপারে এয়ার ভাইস মার্শাল তোয়াব এবং কর্নেল ফারুক রশীদরা পরের বছর মে পর্যন্ত তুমুল চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হন। লিবিয়ার আনুকূল্যে তাদের অভ্যুথান প্রচেষ্টা সেনাবাহিনীতে তেমন পাত্তা পায়নি। ১৫ অগাস্টের হোতাদের একজন লে.কর্নেল রশীদ তার কিছুদিন পর মার্কিন সাংবাদিক লুই সিমন্সকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে সখেদে জানান, জিয়া তার প্রতিশ্রুতি থেকে সরে এসেছেন। রশীদ বলেন :

THERE WAS A GROWING DIFFERENCE BETWEEN ZIA AND TAWAB,” HE SAID. “TAWAB WANTED TO HAVE BANGLADESH DECLARED AN ISLAMIC REPUBLIC AND UNITE FIRMLY WITH OTHER ISLAMIC STATES FOR FINANCIAL AND MORAL SUPPORT”-AN ANTI-INDIAN MOVE.

ZIA WAS STRONGLY OPPOSED TO THIS, RASHID SAID, ADDING THAT ZIA IS GRADUALLY DROPPING THE ANTI-INDIAN POSTURE WITH WHICH HE TOOK CONTROL OF BANGLADESH FOLLOWING A BLOODY ARMED MUTINY IN DACCA NOV. 7. RASHID SAID THAT AT ONE POINT DURING HIS CONVERSATION WITH ZIA, THE GENERAL TOLD HIM THAT BANGLADESH COULD NOT SURVIVE IF IT CONTINUED TO BE ANTI-INDIAN.

ভারতের বিরোধিতা করে টেকা যাবে না জিয়ার এই উপলব্ধির পেছনে সঙ্গত কারণ ছিল। সেটা অন্য কোনও লেখায় আলোচনা করা যাবে। তবে বাংলাদেশের ইসলামী করণে মোশতাকের অসম্পূর্ণ কাজগুলো জিয়া দক্ষ হাতেই সেরেছেন রাজনীতিতে নেমে, রাষ্ট্রপতি হয়ে। তার প্রতি ভুট্টোর শুভেচ্ছার প্রথম উপহারটিও ছিল বেশ দামী- একটি ৭০৭ বোয়িং বিমান। ’৭৬ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতা বিপ্লবের প্রথম বার্ষিকী উপলক্ষে এটি ছিল তার ‘মুসলিম ভাই’দের জন্য ভুট্টোর আরেকটি নজরানা।


সুত্রঃ BdNews

 

শুভ জন্মদিন অভিজিৎ রায়।

 শুভ জন্মদিন অভিজিৎ রায়।🙏

.
বাংলাদেশে বিজ্ঞান মনস্ক লেখকদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম শ্রেষ্ঠ। মুক্তচিন্তা, মানবতাবোধ আর বিজ্ঞান ছিলো তাঁর অনন্ত পথযাত্রা। লেখায় আঘাত করতে চেয়েছিলেন ধর্মান্ধতা কে, কোন ধর্মের বিরুদ্ধে নয়। নিজের লেখায় খুলে দিয়েছিলেন সমাজের চিরচেনা মুখোশ।
.
আজীবন তিনি ছিলেন মনবতাবাদী‌।
যদিও তিনি অবিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু বলতেন,
.



"আমি নাস্তিক। কিন্তু আমার আশে পাশের বহু কাছের মানুষজন বন্ধু বান্ধবই মুসলিম। তাদের উপর আমার কোন রাগ নেই, নেই কোন ঘৃণা। তাদের আনন্দের দিনে আমিও আনন্দিত হই। তাদের উপর নিপীড়ন হলে আমিও বেদনার্ত হই। প্যালেস্টাইনে বা কাশ্মীরে মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর অত্যাচার হলে তাদের পাশে দাঁড়াতে কার্পণ্য বোধ করি না। অতীতেও দাঁড়িয়েছি, ভবিষ্যতেও দাঁড়াবো। এটাই আমার মানবতার শিক্ষা।"
.
পেশায় ছিলেন প্রকৌশলী । কিন্তু তাঁর নেশা ছিলো ব্লগ আর বিজ্ঞান বিষয়ক লেখালেখিতে। তিনি মোট ১০টি বই প্রকাশ করেন। বিজ্ঞান, নাস্তিকতাবাদ, বাস্তববাদ, সন্দেহবাদ ও যৌক্তিকতার ওপর ভিত্তি করে রচিত অবিশ্বাসের দর্শন এবং বিশ্বাসের ভাইরাস।
আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী, মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে, স্বতন্ত্র ভাবনা : মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধির মুক্তি, সমকামিতা: একটি বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান, অবিশ্বাসের দর্শন, বিশ্বাস ও বিজ্ঞান,শূন্য থেকে মহাবিশ্ব , কিংবা বিশ্বাসের ভাইরাস‌। কি অসামান্য তাঁর যুক্তি বুদ্ধি, বিজ্ঞানভিত্তিক মতামত। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে নিয়ে লিখেছিলেন :
ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো এক রবি-বিদেশিনীর খোঁজে।
.
বাংলাদেশে আমাদের মাঝে, কেঁচোর মতো অজস্র মেরুদণ্ডহীন উগ্রবাদীর বসবাস। যারা ভয়ে গর্তে সিধিয়ে পড়ি, বিপদ দেখলে লুকিয়ে বাঁচি। অথচ তাঁর অভ্যাস ছিলো স্রোতের বিপরীতে চলে সত্য জানান দেয়া। যা তাঁর "অবিশ্বাসের দর্শন" এবং "বিশ্বাসের ভাইরাস" বই পড়লে বোঝা যায়। কিন্তু জবাবে তাঁর উপর এলো চাপাতির কোপ। যারা লেখার বদলে বদলা নেয় চাপাতির কোপে।
.
তাঁকে বোঝার সামর্থ্য এই উগ্রবাদীদের হয়নি কখনো হবেনা। তাঁকে বোঝার যোগ্যতা এই অজ্ঞ হিংস্র জীবদের কখনোই হবেনা। বাংলাদেশ ছিলো তাঁর ভীষণ প্রিয়। প্রতিবছরই আমেরিকা থেকে ছুটে আসতেন কেবলই মাতৃভূমির টানে। সেই মাতৃভূমিতে, তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বইমেলার ধারেই তাঁকে খুন হতে হলো চাপাতির কোপে। এরচেয়ে ভয়াবহতা আর কি হতে পারে?
.
ধর্মান্ধ আর উগ্রবাদী দেশে গোবরে পদ্মফুল হয়ে জন্মেছিলেন তিনি। উলুবনে মুক্তা ছড়াতে চেয়েছিলেন। বিপরীতে কি হলো...!
তাঁর বইয়ের নামের মতোই তিনিও আলো হাতে চললেন আঁধারের যাত্রী হয়ে।
.
অভিজিৎ রায়ের জন্ম হয়েছিলো আসামের শিবনগরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে। তাঁর
গর্ভবতী মাকে ভারতের আসামে রেখে বাবা অজয় রায় অংশ নিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। আসামের শিবনগরের নাজিরা ম্যাটারনিটি সেন্টারে জন্ম হয়েছিলো তাঁর।
.
মূলত বাবার হাতেই তাঁর মুক্তচিন্তার হাতেখড়ি। লিখেছিলেন নিজেই-

"বাবা আমাকে ‘রাজপুত্রে’র মত বড় করতে পারেননি বটে, কিন্তু বাবাই আমাকে যত রাজ্যের বইয়ের জগতের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। আমাদের শেলফে হাজারো বইয়ের পাশাপাশি ছিলো মুক্তধারার কিশোর –বিজ্ঞানের মজার মজার সমস্ত বই। জাফর ইকবালের ‘মহাকাশে মহাত্রাশ’ কিংবা স্বপন কুমার গায়েনের ‘স্বাতীর কীর্তি’ কিংবা ‘বার্ণাডের তারা’ এগুলো তার কল্যানেই পড়া। বাবাই আমাকে হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন সুকুমার রায়ের রচনা সমগ্র। হযবরল-এর বিড়াল, পাগলা দাশু আর হেশোরাম হুঁশিয়ারের ডায়রীর কথা জেনেছি তার কাছ থেকেই। বাবাই আমার মনে বপন করেছিলেন মুক্তবুদ্ধি আর সংশয়ের প্রথম বীজ। বাবাই আমাকে আবৃত্তি করতে শিখিয়েছিলেন রবিঠাকুরের প্রশ্ন কবিতা ।"
যে পথে থাকে পদে পদে ভয়, সে পথে ঝুঁকি সত্ত্বেও তিনি এগিয়েছেন দৃঢ়চিত্তে। তাইতো তিনি থাকবেন মহাকালের বুকে নক্ষত্র রূপে।

.
আজ অভিজিৎ রায়ের জন্মদিন। বিনম্র শ্রদ্ধা অভিজিৎ রায়ের প্রতি। 🙏💕