Sunday, December 13, 2020

বাংলাদেশ ও কিছু কথা

 পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলীর নাতি আমার সিনিয়র ফ্রেন্ড। তেমন ক্লোজ কেউ না মাঝে মাঝে বিভিন্ন পার্টিতে দেখা হত আড্ডা হত এইটুকুই। তিনি ছিলেন আবার MIT Graduate । ইন্জিনিয়ার। 

বাংলাদেশে চীনের মেজর ব্রীজ কোম্পানীর কনসাল্টেন্ট ছিলেন। আবার তিনি তখনকার বাংলাদেশে আমেরিকান রাষ্ট্রদুত ড্যান মজিনার স্কুল মেট। 

তো তিনি এক আডডায় গল্প বলছিলেন যে, মজিনা বাংলাদেশে নিয়োগ নিয়ে আসার পর আমেরিকান দুতাবাসে এক পার্টিতে মজিনার দাওয়াতে উপস্থিত ছিলেন। অনেক কথার পর মজিনা তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আচ্ছা একটা জিনিস বলো তো, আমি যখন বাংলাদেশে আসি তখন আমাকে বাংলাদেশ আর বাঙালী সম্পর্কে ব্রীফ করা হয়েছিল যে, “বৃটিশরা বলত বাঙালীরা আজ যা চিন্তা করে পুরো উপমহাদেশ সেটা একদিন পরে চিন্তা করে। তো আমি তো সেরকম কাউকে দেখলাম না।“ 

তো উত্তরে আমার সিনিয়র বন্ধু হা হা হা করে হেসে বলেছিলেন. কিছু এখনো অবশিষ্ট আছে এদেশে তবে ওপার বাংলায় কিছু আছে আর আমাদের দেশের বেশীরভাগ ওইলেভেলের মানুষদেরকে ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বরে মেরে ফেলা হয়েছিল। মজিনা বলেছিলেন oh I see. 


আজকে পদ্মা ব্রীজের সাফল্যে একটা পক্ষের আনন্দ বা গর্বে উদ্বেলিত না হতে পারা দেখে মনটা বিষন্ন হল। যে কারনে আজকের লেখার অবতারনা।

জিয়নিষ্ট বৃটিশরা কিভাবে আমাদের বাংলাকে ধ্বংস করেছিল সেটা আমি কারেন্সী ওয়ার সিরিজে অল্প হলেও লিখেছি। কিন্ত যেটা লিখিনি সেটা হল। 

তাঁরা এখান থেকে চলে গেলেও তাঁদের “ভাগ কর শাসন কর নীতি” র বীজটা পাকা পোক্ত করে তারপর এখান থেকে গিয়েছিল যেটা আমরা অনেকে অনুধাবন করিনা গভীর দৃষ্টির অভাবে। এটা বানরের পিঠা খাওয়ার গল্পের মতন, যাতে তারা সবসময় ফায়দা হাসিল করতে পারে দুই পক্ষের ঝগড়া মেটানোর ছলে। 

তারা হিন্দু –মুসলিমে ভাগ করার পর, পুর্ব পাকিস্তানের মানুষ যখন তাঁদের রচিত সাম্প্রদায়িকতাকে পিষে ফেলে বাঙালী জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করে ফেলল তখন তাদের মাথায় ঠাডা পড়ে গেল। খেয়াল করে দেখুন ভাল করে। 

এই উপমহাদেশের এতগুলো জাতি আর ভাষায় বিভক্ত জাতির কেউ কিন্তু স্বাধীন দেশ বানাতে পারেনি। মনিপুরীরা পারেনি, নাগা বা পারেনি, গোর্খারা পারেনি, তামিল, কাস্মীরী, পাঞ্জাবী, সিন্ধি, বেলুচ কেউ পারেনি। তাঁরা এখনো ফাইট করে চলেছে কিন্তু তাঁরা পারেনি। 

আমরা পেরেছিলাম। কিন্তু সেটা ছিল বিপুল ক্ষয়ক্ষতির বদলে অল্প কিছুদিনের জন্য । তাঁদের ভাগ কর শাসন কর নীতি আবার কলকাঠি নেড়েছিল । এবং স্বাধীন বাংলাদেশ আবার দুভাগে বিভক্ত করে ফেলে তাঁরা ৭৫ এর পরেই। 

এবার হিন্দু মুসলীমে ভাগ করেনি এবার তাঁরা করেছে স্বাধীনতার পক্ষে এবং বিপক্ষে এই দুটি শক্তি দ্বারা। ভাল করে খেয়াল করে দেখবেন ৭০ সালে আওয়ামীলীগ ভোট পেয়েছিল ৯৮ % এবং তাঁরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষেই মত দিয়েছিল । কিন্তু ১৯৯১ সালের ভোটে দেখা গেল সেই আওয়ামী লীগ ভোট পেল ৩৬ % । আর বিপক্ষে বিএনপি জামাত পেল প্রায় সমান সমান। যারা নতুন ভোটার ছিল ২১ বছর পর তারা কেউ মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি বা ৭৫ দেখেনি।

 তারা কেবল শুনেছিল একটি মাত্র সরকারি রেডিও চ্যানেল এবং একটি টেলিভিশন চ্যানেলের বদৌলতে। স্কুলের বইতেও তেমন কিছুই লেখা ছিলনা।

 এবং আমরা যারা ৮০র দশকে স্কুলে পড়েছি তাঁদের কাউকেই আমরা দেশ নিয়ে বা মুক্তিযুদ্ধের মত এতবড় ত্যাগের বিনিময়ে এতবড় বিশাল অর্জন নিয়ে কখনো গর্ব অনুভব করতে দেখিনি। ৭১এর যুদ্ধকে বলা হত গন্ডগোলের সময়। মানে দুইভাইের ভিতর কিছুটা ভুল বোঝাবুঝির কারনে কিছুটা ঝগড়াঝাাটি হয়েছিল।এর বেশী কিছুনা। বঙ্গবন্ধুকে আমরা কখনোই রেডিও টিভিতে পাইনি ৯৬ এর আগে।

 যা এই উপমহাদেশের কেউ অর্জন করতে পারেনি হাজার চেষ্টা করে আমরা যখন সেটা পেরেছি সেটা নিয়েও আমাদের কোন অনুভুতি কাজ করেনা। কারন ৭৫ থেকে ৯৬ পর্যন্ত এতগুলি জেনারেশনকে মগজধোলাই করা হয়েছিল একটি রেডিও এবং একটি টিভি দিয়ে। কিন্তু কেন ?

এর উত্তর দিয়েছিলেন ফিডেল ক্যাষ্ট্রো ১৯৭৪ সালে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে । আলযিয়ার্সে যখন বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা হয় ফিডেলের তখন তিনি বলেছিলেন বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ্য করে, “কমরেড ইউ আর ফিনিশড” কারন বঙ্গবন্ধু ৭১ সালে যে সব আমলারা পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল তিনি তাঁদের আবার সরকারী চাকরীতে স্বপদে বহাল করেছিলেন। 

বঙ্গবন্ধু তখন বলেছিলেন, আমি কি করব, আমার তো দেশ চালানোর জন্য অভিজ্ঞ লোক লাগবে যেটা আমার কাছে নেই। কারনটা সবাই জানেন কেন ছিল না। ১৪ই ডিসেম্বরই ছিল সেই কারন। 

ফিডেল পাত্তা না দিয়ে হাভানা চুরুটে টান দিয়ে আবার বললেন, “ কমরেড ইউ আর ফিনিশড. ইউ আর ফিনিশড। ভুলে যেওনা তুমি যাদের নিয়োগ দিয়েছ তারা কিন্তু পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েও পাকিস্তানের ধ্বংস ঠেকাতে পারেনি। তাহলে তুমি কিভাবে ধরে নিলে যে এরা স্বাধীন বাংলাদেশকে সঠিকভাবে সেবা করবে? তুমি সবাইকে সরিয়ে দাও ।

 যেসব অনভিজ্ঞ লোক আছে তারাই একদিন শিখে যাবে ভুল করতে করতে অর এলস ইউ আর ফিনিশড কমরেড।“ বিদায় নেবার সময় দুজনেই জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলেন। আর যাবার সময় বলেছিলেন, আমি হিমালয় দেখিনি কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি।“

 তার কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য হয়েছিল। শুধু যে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে ফিনিশ হয়েছিল তাই নয় বিপুল পরিমানে রাজাকারদের পুনর্বাসন করা হয়েছিল সামরিক সরকারের আমলগুলোতে।যার ধারাবাহিকতা ৯৬ সাল পর্যন্ত ছিল। 

এবং এমন জেনারেশন তৈরী হল যাদের দেশপ্রেম কি জিনিস সে বিষযে ধারনা ছিল না। ১৯৭১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পেরেছিল মাত্র সাড়ে ৪ হাজার মেগাওয়াট ! শিল্প বিপ্লব হবে কি করে ? কারন পিছনে কলকাঠি নেড়েছিল বিশ্বব্যাংক। আর ২০০৭ থেকে ২০ এর ভিতর এখন ২২ হাজার মেগাওয়াট ।

 কারনটা সহজে অনুমেয়। শিল্প বিপ্লবটাও দেখেন চারপাশে ভাল করে। যেকোন দেশের উন্নয়নের পিছনে মুল শক্তি হল জ্বালানী। আর জ্বালানী খাতে বিশ্বব্যংক তৃতীয় বিশ্বের দেশের সাথে যা করে থাকে সেটা জমিদারীর নীল চাষের মত।

 সেই বিশ্বব্যাংকই এই পদ্মাসেতুর বিরুদ্ধে ছিল এবং চরম একটি অপবাদ দিয়েছিল বাংলাদেশের সম্মানে। আমরা যদি মেনে নিতাম অপবাদটা তাহলে আজকে আমরা এই অবন্থানে থাকতামনা। 

একটা মানুষের কঠিন জিদ আমাদের দেশের মর্যাদা এবং আত্মসম্মান উচু করেছে। আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে কিন্তু একদল মানুষ সেটা উপভোগ করতে পারছেননা । এই মানুষগুলো জন্য দু:খ হয়। এরা না পারে ফেলতে না পারে গিলতে তবু মোহ ভাঙেনা । 

 পদ্মা সেতু তখন না হওয়াতে  আপনাদের কারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিলেন আমি জানি না। তবে আমার ১১ লাখ টাকা গচ্চা গিয়েছিল তখন না হওয়াতে। যে টাকা এখনো শোধ দিতে পারিনি। আমরা কয়েকজন মিলে তখন ইনভেষ্ট করেছিলাম সাপ্লাইয়ের কাজ পাব বলে। দু:খ আমার হবার কথা কিন্তু আমি খুশী কারন আমি জানি এটা দেশের জন্য কত বিশাল অর্জন।


 যারা যারা এই বিশাল যজ্ঞে শামিল ছিলেন তাঁদের সবাইকে টুপি খোলা অভিনন্দন। আর যাদের কাছে মনে হচ্ছে এটা কিছুই না তাঁদের বলছি ছবিটা উপর থেকে দেখেন তাহলে বুঝবেন এটা কতবড় থাপ্পড় ছিল জিয়নিষ্টদের গালে। সবাইকে বিজয় দিবসের আগাম শুভেচ্ছা।

No comments:

Post a Comment