প্রথমে রামায়ণ প্রসঙ্গেই কথা বলব: আমার মতে, রামায়ণ সবথেকে অবহেলিত চরিত্র উর্মিলা।
লক্ষণের স্ত্রীর নাম উর্মিলা। রাজা জনকের একমাত্র** কন্যা উর্মিলা, সীতা দেবীর বোন। তার স্বামী লক্ষণ অগ্নিসাক্ষী করে তাকে বিবাহ করেছিলেন, আর্য পুত্র বৈদিক মন্ত্র পাঠ করে তার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু সেই দায়িত্ব পালন লক্ষণ করেননি। এমনকি উর্মিলাকে বোঝার চেষ্টাও লক্ষণ করেননি।
রামের 14 বছর বনবাস হয়। সীতা, রামের সহধর্মিনী হওয়ায় রামচন্দ্রের সাথে বনে যেতে চেয়েছিলেন। স্বামীর সাথে স্ত্রীর যাবেন এটা খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। কিন্তু লক্ষণও তার দাদার সাথে 14 বছরের জন্য বনবাসের শাস্তি গ্রহণ করে। এবং 14 বছরের জন্য দাম্পত্য জীবন থেকে তার স্ত্রী উর্মিলাকে বঞ্চিত করেন। উর্মিলা চেয়েছিলেন রাম লক্ষণ এবং সীতার সাথে বনবাসে যেতে। তার জন্য তিনি কাকুতি মিনতিও করেন লক্ষণ এর কাছে। কিন্তু লক্ষণ কিছুতেই রাজি হননি উর্মিলা কে সঙ্গে নিয়ে যেতে। তিনি উর্মিলা কে আদেশ করেন, যে এই 14 বছর উর্মিলা যেন একনিষ্ঠভাবে তাদের পিতা-মাতার সেবা করেন।
উর্মিলা কে অবহেলিত করা হয়েছে। রঘুনন্দন লক্ষণ একজন সূর্যবংশীয় স্বামী হিসেবে তাকে অবহেলা করেছেন। রামচন্দ্র লক্ষণ কে বনবাসে যেতে বারণ করেছিলেন কিন্তু কখনই বলেননি যে, উর্মিলার প্রতি লক্ষণের একটা দায়িত্ব আছে এবং সেই দায়িত্বটা লক্ষণ পালন করছেন না।
অভিমানী উর্মিলা এর প্রতিশোধ নিয়েছিলেন নিজেকে কষ্ট দিয়ে। ওই 14 বছর সময়টায় তিনি ব্রহ্মচর্য পালন করেছিলেন। রাজকন্যা শুতেন খড় বিছিয়ে মাটিতে। ফল ছাড়া আর কিছু আহার করতেন না।
14 বছর পর যখন রামচন্দ্র, সীতা মাতা এবং লক্ষণ চলে আসেন। তখন উর্মিলা ভঙ্গ করেন তার ব্রহ্মচর্য। সংসার করেছেন লক্ষণের সাথে। অঙ্গদ এবং ধর্মকেতু নামের দুই সন্তানের জননী হয়েছিলেন।
উর্মিলার এই আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করার জন্য। রাজস্থানের ভরতপুর জেলায় ১৮৭০ সালে ভরতপুর জেলার শাসক রাজা বলবন্ত সিং একটি মন্দির নির্মাণ করেন। ওই মন্দিরে উর্মিলা এবং লক্ষণের পুজো করা হয়।
মহাভারতের সবথেকে উপেক্ষিত চরিত্র বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় এর মতে সূর্যপুত্র কর্ণ। পথের পাঁচালী উপন্যাসে বিভূতিভূষণ ছোট্ট অপুর মুখ দিয়ে অসাধারণভবে ব্যক্ত করেছেন বীরযোদ্ধা কর্নের অবহেলার কাহিনী। ছোট্ট অপুর শিশু চোখ দিয়ে ঝরেছে বিভূতিভূষণের অশ্রু।
বিভূতি বাবুর অপরূপ, অসাধারণ, যুগান্তকারী সাহিত্যিক বর্ণনার ঊর্ধ্বে উঠে কোন কিছু লেখার ক্ষমতা আমার নেই। কিন্তু বিভূতিবাবু বোধহয় বন্দ্যোপাধ্যায় টাইটেল থাকার জন্যই সূর্য পুত্রের প্রতি আপনার দুর্বলতা তৈরি হয়ে গেল। মাস্টারমশাই। আপনার চোখ এড়িয়ে একলব্য বাদ চলে গেল, স্যার। দেখলেন না, ওই সিডিউল ট্রাইপ ছেলেটাকে।
দ্রোণাচার্যের কাছে অস্ত্র বিদ্যা শেখার উদ্দেশ্যে একলব্য এসেছিলেন। নিচু জাত বলে তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হলো। বঞ্চিত করা হলো বিদ্যা লাভ করা থেকে। নিচু জাত আবার অস্ত্রশিক্ষা নিয়ে কি করবে, ট্যালেন্ট যদি থাকে তাহলেও সেই ট্যালেন্টএর মূল্য কি? ওদের কোদাল চালানো শেখা প্রয়োজন। দ্রোণাচার্যের কাছে অস্ত্রশিক্ষা নেবেন রাজপুত্ররা। রাজা ব্যাটা রাজা হবে।
দুর দুর করে একলব্য কে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন দ্রোণাচার্য। কিন্তু একগুঁয়ে সিডিউল ট্রাইব ছেলেটা গুরু দ্রোনাচার্যের মূর্তি তৈরি করে তাকে গুরু হিসেবে গ্রহণ করে ধনুর্বিদ্যা অনুশীলন করতে থাকলেন। নিষ্ঠা, তাকে ভারতের শ্রেষ্ঠ ধনুর্বিদে পরিণত করল। চন্দ্রবংশের সর্বশ্রেষ্ঠ ধনুর্বিদ অর্জুনকে পর্যন্ত টেক্কা দেওয়ার মতন ক্ষমতা অধিকার করলেন একলব্য।
হীরে অন্ধকারেও চকচক করে। প্রতিভা লুকিয়ে থাকে না। ধরা পরে গেলেন একলব্য। পড়বি তো পড় দ্রোণাচার্যের সামনেই।
-কিভাবে শিখলে এই ধনুর্বিদ্যা? কে তোমার গুরু?
অরণ্য প্রকৃতির কোলে থাকা সহজ সরল ছেলে একলব্য। ধনুর্বিদ্যা তে সে অনেক অনেক পারদর্শী, কিন্তু কুটকাচালি, কূটনীতি সে বোঝেনা। সরল ভাষায় উত্তর দিল-
"গুরু দ্রোণাচার্য আপনি আমার গুরুদেব। আপনি প্রত্যাখ্যান করার পর, আমি আপনার মূর্তি তৈরি করে, তার সামনে ধনুর্বিদ্যা অনুশীলন করেছি এবং আপনার আশীর্বাদে আমি আজ সফল হতে পেরেছি।"
দ্রোণাচার্য খুব ভালো মতনই জানতেন যে তার মাটির পুতুলটা হয়তো একলব্যের মধ্যে কনফিডেন্স গ্রো করেছে। কিন্তু ধনুর্বিদ্যায় একলব্য পারদর্শিতা অর্জন করেছেন অনুশীলনের মাধ্যমে। যার কোন বিকল্প হয় না।
রাজার ব্যাটাই রাজা হবে।
গুরু দ্রণ তার জীবিকা নির্বাহন কারী ধনুক বান পাশে সরিয়ে রাখলেন। একলব্য এর কাছে এগিয়ে গেলেন। অহংকারী ক্রুদ্ধ গলায় বললেন-
কাউকে না জানিয়ে তার জিনিস গ্রহণ করাকে চুরি বলা হয়, একলব্য।
-চুরি?!
- চুরি! চুরি! হ্যাঁ একে চুরি বলা হয়। একলব্য।
চুরির অপবাদ শুনে ভয় পেয়ে গেলেন একলব্য। এই ভয়টা ওদের আছে। এখনো এই ভয়টা ওদের আছে। দেখবেন মাত্র 10 হাজার টাকা ঋণ শোধ করতে না পারার জন্য একজন কৃষক গলায় দড়ি দেয়। ওদিকে 10 লক্ষ কোটি টাকা চুরি করে নিয়েও বুক বাজে বিদেশে চলে যায়, রাজার বেটা রাজা।
একলব্য কে একটু ভয় দেখানোটাই দ্রোণাচার্যের উদ্দেশ্য ছিল। এবার উনি আসল প্রসঙ্গে আসলেন। বললেন-.তুমি যে আমার কাছ থেকে এত সুন্দর ধনুর্বিদ্যা শিখে বিশ্বের সেরা ধনুর্ধর এ পরিণত হলে তার জন্য আমাকে গুরুদক্ষিণা দেবে না?
চমকের ওপর চমক। বিপুল সম্পদের অধিকারী রাজগুরু দ্রোণাচার্যকে কি গুরুদক্ষিণা দিতে পারে এক সাধারণ সিডিউল ট্রায়প ছেলে? কিবা আছে এদের কাছে? কি বা পেয়েছে এরা? দু'মুঠো ভাত জোগাড় করতেই তো কেটে যায় সারাবেলা কি দেবে একলব্য, গুরু দ্রোণাচার্যকে?
কেন?
আত্মত্যাগ, বড় হবার স্বপ্ন, মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর ইচ্ছে, আর রাজার ব্যাটাকে রাজা করার প্রজাতান্ত্রিক মর্যাদা!
গুরু দ্রোণাচার্য সেদিন যদি একলব্যের প্রাণ চাইতেন তাহলে হয়তো তার ওপর একটু হলেও করুনা করা হত। দ্রোণাচার্য একলব্য এর কাছে চাইলেন। তার ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুল।
মহাভারতে লেখা নেই। কিন্তু আমি জানি, সেদিন একলব্য চোখের জল ফেলেনি। কারণ হাজার হাজার বছর ধরে আত্মত্যাগ করতে করতে ওদের ডিএনএ গুলো চোখকে কাঁদতে বলার প্রোগ্রামিং মুছে দিয়েছে।
রাজার ব্যাটাই রাজা হল
একলব্য তার।কোমর থেকে তরোয়াল টা কে বার করে। তার ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুল টা কেটে গুরুদক্ষিণা হিসেবে দিয়ে দিলেন চন্দ্রবংশের স্বনামধন্য গুরু দ্রোণাচার্য কে।
রাজার ছেলে রাজা হবেই
এখন বর্তমান গণপ্রজাতন্ত্রী ভারতবর্ষে খেলার জন্য শ্রেষ্ঠ কোচকে দেওয়া হয় দ্রনাচার্য পুরস্কার। শ্রেষ্ঠ খেলোয়ারদের দেওয়া হয় অর্জুন পুরস্কার।
আমি জানিনা। তবে আমার মনে হয় ওই অনুষ্ঠান গুলি একলব্যরাও দেখে টিভির পর্দা দিয়ে। দাঁতে দাঁত চিপে তারা বিড়বিড় করতে করতে সেই সময় বলে- 'এবার রাজার ছেলে আর রাজা হবে না। রাজা সেই হবে যে রাজা হবার যোগ্য"।
মহাভারত এ অবহেলিত চরিত্র একাধিক রয়েছে। যেমন একাধিক চরিত্রের সহাবস্থান হয়েছে এই কাব্যে, সেরকম ভাবেই একাধিক চরিত্র তার প্রাপ্য সম্মান পায়ে নি বা ধরে নেওয়া যেতে পারে এই কাব্যের রচয়িতা বা রচয়িতারা সকলেই একই পথ অনুসরণ করেছেন।
১.যেমন অবহেলিত চরিত্র বলতে প্রথমেই সবার অঙ্গ রাজা কর্ণের কথা মনে হয়। সত্যিই সে অবহেলিত চরিত্র যদিও তাঁর চারিত্রিক কিছু দোষের উল্লেখ আমরা মহাভারতে পাই কিন্তু তিনি সূর্য পুত্র হলেও তাঁকে কিন্তু দেবতার চরিত্র বলে মহাভারতে বলা হয় নি। বলা হয়েছে একজন মানুষ হিসাবে, আর মানুষ হিসাবে তার মধ্যে দোষ আর গুণ দুটোই থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাঁর দোষের থেকে তার প্রতি অনাচার আর অবহেলার ছবিটাই যেন বেশি স্পষ্ট তাঁর জীবনের শেষ লগ্ন পর্যন্ত।
২. হিরিম্বা হলো আর এক অবহেলিত চরিত্র। দাদা হিরিম্ব এর কথায় পঞ্চপান্ডব কে মেরে খাবার জন্য হিরিম্বা সেখানে পৌঁছে একমাত্র জাগ্রত ও পাহারারত ভীষন দেহী ভীম কে দেখে তাঁর প্রেমে পরে গেলেন এবং বিবাহ প্রস্তাব দিয়ে বসলেন। শেষে কিনা যুদীষ্ঠির এর কথায় ভীম বিবাহে রাজী হলেন এবং বিনিময় হিরিম্বা নিজের দাদাকে ভীম এর হাতে মরতে দিলেন। সেই বিবাহও ছিল কিন্তু শর্তসাপক্ষ। তবুও সে কিন্তু ভীমের পত্নী হবার যোগ্য প্রাপ্য পেলেন না, যেমনটা দ্রৌপদী পেলেন। যদিও দ্রৌপদীকে কিন্তু ভীম অর্জন করেননি করেছিলেন অর্জুন আর ভীম হিরিম্বাকে তাঁর দাদা হিরিম্ব কে লড়াইতে পরাস্ত করে।
৩. এবার হিরিম্বাপূত্র ঘটোৎকচের কথায়ে আসি। পিতা ভীম এর মতো অসীম সাহসী এবং পিতা ভীম এর ন্যায় অসীম দৈহিক বল ও ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন এই ঘটোৎকচ। কিন্তু তিনিও কিন্তু তাঁর মায়ের মতো যোগ্য সম্মান পেলেন না। সেটা কি কেবলমাত্র সে তাঁর মায়ের মতো অনার্য ছিলেন তাই? তার উপর তাঁকে কিনা ব্যবহার করা হলো যুদ্ধে বলির স্বরূপ হিসাবে। যাতে কিনা সেই অভাগা কর্ণ তাঁর ইন্দ্রের দেওয়া বাসব শক্তির প্রয়োগ তাঁর উপর করে এবং হত্যা করে। শুধুমাত্র অর্জুন কে কর্ণের হাত থেকে বাঁচাতে ঘটোতকচ কে বলি দেওয়া হলো।
৪. কৌরব আর পাণ্ডবদের অস্ত্রগুরু কৃপাচার্য এর কথায় আসি। মহাভারতে দ্রোণাচার্য এর আগে কৃপাচার্য এর একটা সম্মানিত স্থান ছিল কৌরব বংশে। কিন্তু দ্রোণাচার্য আসবার পর থেকে কৃপাচার্যকে যেন ইচ্ছা করেই অনেক পিচ্ছনে ঠেলে দেওয়া হলো। সব স্থানেই আছেন কিন্তু যেন সেরকম কোনো ভূমিকাই নেই। সব সম্মান দ্রোণাচার্য নিয়ে গেলেন। যদিও ভীষ্ম কৃপাচার্যকে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় মহারথী বলে সম্মানিত করেছিলেন কিন্তু নিজের বীরত্ব দেখাবার সেরকম জায়গা তিনি পেলেন না। সেটার কারণ তাঁর পাণ্ডব প্রীতি হতেও পারে।
৫. অর্জুনের চার পত্নী (দ্রৌপদী, উলুপী, চিত্রাঙ্গদা ও সুভদ্রা)। এরমধ্যে কেবল মাত্র দ্রৌপদী এবং সুভদ্রা ছাড়া বাকি দুজন কিন্তু মহাভারতে হঠাৎ দেখা উল্কাপাত এর মত আবির্ভাব হয়েই মিলিয়ে গেছে। অথচ এদের দুইজনেরই অর্জুন এর পত্নী হবার যোগ্য সন্মান পাওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু ঘটনার বিবর্তন এনাদেরকেও অবহেলা করেছেন। অথচ উলুপির পুত্র ইরাবান কিন্তু অর্জুনের পুত্র হবার দায়িত্ব পালন করেছেন এবং পাণ্ডব পক্ষে যথার্থ যুদ্ধ করে বীরের মতো প্রাণ দিয়েছেন আবার চিত্রাঙ্গদা র পুত্র বভ্রুবাহণ কর্তৃক অর্জুন কিন্তু পরিশেষে সম্মুখ যুদ্ধে পরাজয় স্বীকার করেছেন।
৬. এবার আসি দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্রের কথায়। প্রতিবিন্ধ্য, সুতসোম, শ্রুতকর্মা, শতানীক ও শ্রুতসেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের শেষদিন পর্যন্ত বীরের মত যুদ্ধ করেছেন এই পাঁচ ভাই নিজেদের পিতাদের পাশে দাড়িয়ে আর শেষে কিনা এই পাঁচ বীর যোদ্ধাকে রাত্রে ঘুমন্ত ও নিরস্ত্র অবস্থায় অশ্বত্থামা র হাতে মরতে হলো।
৭. এবার আসি এক শিশুশিল্পী র কথায়। একলব্য । মনেহয় মহাভারতের রচয়িতারা এনাকে ইচ্ছা করেই মনে রাখতে চাননি। যেন একটা অভিশাপ এনাকে মনেরাখা। যিনি কেবলমাত্র গুরুর মূর্তি নিজে হাতে গড়ে তার সম্মুখে ধনুর বান এর অভ্যাস করে এমন কীর্তির ছাপ রেখেছিলেন যে স্বয়ং অর্জুন ভয় পেয়ে তাঁর গুরুকে ভর্ৎসনা করেছিলেন। ফলে গুরুদক্ষিণা বাবদ একলব্য এর বৃদ্ধাঙ্গুলি টি কাটা পড়েছিল। ব্যাস অকেজো করে দেওয়া হলো এক প্রচন্ড প্রতিভা কে। বিভিন্ন জায়গাতেই দেখি সবাই কর্ণ আর অর্জুন এর তুলনা করেন কই কেউ তো একলব্য এর সাথে এদের তুলনা করেন না। আসলে সবাই জানে কে প্রকৃত ধনুর্বিদ। তাই মহাভারতের রচয়িতারা একলব্য কে চরম অবহেলা করলেও পাঠকগণ কিন্তু ওই Guest Apperance চরিত্রটিকে আজীবন মনে রেখেছেন তারা কিন্তু অবহেলা করেননি।
৮. শেষে আসি ভীষ্মের কথায়। সারা জীবনের সমস্ত সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করলেন অন্যের কথা ভেবে। পিতা শান্তনুর দ্বিতীয় বিবাহের কথা ভেবে এবং সেইমত সত্যবতীর বাবাকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিজে বিবাহ করলেন না সারাজীবন একা কাটালেন। এরপর শান্তনুর মৃত্যুর পরেও সিংহাসন এ বসলেন না বরঞ্চ দুই ভাই চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্র বীর্য এর শিশুকাল এ তাদের হয়ে রাজ্য শাসন করলেন। বিচিত্রবীর্য এর জন্য কাশী র সয়ম্ভর সভা থেকে তিন বোনকে ক্ষত্রিয় নিয়ম অনুযায়ী হরণ করে আনলেন আবার ধৃতরাষ্ট্র, পান্ডু ও বিদুর বড়ো না হওয়া পর্যন্ত তাদের হয়ে আবার রাজ্য শাসন করলেন। কিন্তু একবারও সিংহাসন পেলেন না বা রাজার মর্যাদা পেলেন না। এরপর চোখের সামনে কৌরব দের দুষ্ট কীর্তি আর কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পটভূমি তৈরি হতে দেখতে লাগলেন কিন্তু তাঁর মতপ্রকাশের কোনো স্বাধীনতা পেলেন না বা তাঁর কথা কেউ শুনলেন না। এরপর কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কৌরবদের হয়ে লড়াই করে নিজের কর্তব্য পালন করলেন, নিজে অপরাজেও জেনেও পাণ্ডবদের কাছে শিখণ্ডী র রহস্য ফাঁস করে দিলেন এবং তাঁকে পরাজিত করার রাস্তাও বলে দিলেন। সবথেকে পণ্ডিত, বেদজ্ঞ ও যুদ্ধাস্ত্রের প্রয়োগে তাঁর সমকক্ষ কেউ ছিল না, সমগ্র কৌরব বংশের এবং মহাভারতের মেরুদণ্ড ভীষ্মের প্রতি কিন্তু মহাভারত কাহিনী চরম অবহেলাই করেছেন।
এছাড়াও আরো ছোট বড় অনেক চরিত্র মহাভারতে তাঁদের কীর্তির ছাপ রেখে গেছেন। এবং ইনারা প্রত্যেকেই কিন্তু এই কাহিনীকে সম্পূর্ণতা দান করেছেন। কিন্তু আমরা সবাই শেষে ওই হাতেগোনা কয়েকজন কেই মনে রাখি। বাকিদের প্রতি কিন্তু অবহেলাই করি। তাই না?
এটা আমাদের বাস্তব জীবনে প্রত্যেকের ক্ষেত্রে ঘটে থাকে। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে কতগুলো মানুষের সাথে আমাদের যুক্ত হতে হয় এবং এনারা প্রত্যেকেই আমাদের জীবন ও চিন্তন গঠনের জন্য কম বেশি দায়ী থাকে কিন্তু একটা সময় পর কতজন কে আমাদের গভীর চিন্তার জগতে সমান অধিকার দিতে পারি? মহাভারত তার ব্যাতিক্রম কিছু নয়। কথায় আছে যা নেই মহাভারতে, তা নেই ভু-ভারতে।
No comments:
Post a Comment