মান্টো মোবাইলফোনের স্ক্রিন স্ক্রল করে করে তার মায়ের যৌনাঙ্গের ছবিগুলো দেখছিল। কিছুক্ষণ পরেই মা এসে তার পাশে দাঁড়ালেন এবং তার হাত থেকে ছোঁ মেরে মোবাইলফোনটি নিয়ে নিলেন। গালে চটাস করে চর বসিয়ে বললেন, "কী দেখছিস"।
মান্টোর কোন ভাবলেস হলোনা। সে খুব ধীরে ধীরে মাথাটা ঘুরিয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকালো। তারপর চোখটা নামিয়ে বললো, "এই পথেইতো পৃথিবীতে এসছি মা। ওরাওতো এমন'ই পথের শেষে পৃথিবীর আলো দেখেছিল, যারা ছবিগুলো আমায় পাঠিয়েছে"। এই যে বুক তোমার, আমার ক্ষুধার কলশ, তোমার পেটের পেলবতা, আমার মিষ্টি বালুস। আমি তো এর বাইরে কোনদিন ঘুমাই নি।"
"আমার কাছে আর কী লুকোবে মা"।
মা দৌড়ে চলে গেলেন।
মান্টো ছিল সময়ের সবচেয়ে সুন্দর সন্তান। তার বাবা ছিলেন পঙ্গু এবং মা ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষিকা।
মায়ের বয়স তখন আটত্রিশ এবং মান্টোর বয়স তখন ঊনিশের কোঠায়। সেই দুই বছর বয়স থেকে বা তারও আগে থেকে প্রতিদিন মা তাকে স্কুলে নিয়ে যেতেন।
তার মনে পড়ে, কত কত মানুষ তার মায়ের দিকে চোখ ঘুরিয়ে তাকাতো! সে চোখের ভাষাগুলো মান্টো তখনও পড়তে পারে না। সে ছিল অবোধ বাচ্চাটা। মায়ের অবোধ শিশু। এমন অনেক চোখওয়ালা পুরুষও তাকে চকোলেট সাধতো। মান্টো কখনোই তাদের সে চকোলেট ছোঁয়নি।
মা মান্টোর হাত ধরে দ্রুত পাড় হতে চাইতেন যেসব রাস্তা, যেসব রাস্তাগুলোর ছিল নির্লজ্জ এনং সুক্ষ্ম চোখ।
আসা-যাওয়ার সময় মায়ের চোখে থাকতো ঘন উদ্বেগ এবং রাস্তাগুলোর প্রতি ঘৃণা। মান্টো মায়ের চোখ বুঝতে পারতো। মা যখন ক্লাসঘরে বসে বাচ্চাদেরকে পড়াতেন তখন মান্টো চুপচাপ মায়ের পাশে বসে থাকতো। মান্টো মাকে পড়তে চেষ্টা করতো।
মা যেন এক অদ্ভূত বেঁচে থাকার লড়াই। মা যেন কাঁধে অখন্ড পাথরের ভারে নুয়ে পড়া অভিশপ্ত দেবতা সিসিফাস। মা যেন চারপাশের অসংখ্য অলৌকিক প্রেতাত্মার ভয়ে নিয়মিত অস্থির। মান্টো জানেনা, নারী মানেই ঈশ্বরের অভিশাপ, মা জানেন।
নারীকে জানেনা বলেই মাকে নিয়ে মান্টোর দিনরাত এত চিন্তাভাবনা।
স্কুল শেষে মা আর মান্টো সেইসব চোখওয়ালা পথ দিয়ে ফিরে যেতো, যেই পথের কথা একটু আগেই বলেছিলাম।
বাড়ি এসে পঙ্গু বাবার সমস্ত পোশাক আশাক পরিবর্তন করে মা তাকে গোসল করিয়ে দিতেন। বাবা নির্লিপ্তের মতো তাকিয়ে থাকতেন মায়ের মুখের দিকে। কখনও তার চোখে অবিশ্বাস, কখনও হতাশা, কখনও যেন বাবার এক বিরাট দুর্ভিক্ষপীড়িত একটি মুখ মান্টোর চোখে ভেসে উঠতো।
বাবাকে খাইয়ে দিয়ে মা মান্টোকে গোসল করাতেন। তারপর মান্টোর মুখের কাছে খাবার নিয়ে এলে মান্টো মায়ের মুখের দিকে তাকাতো। মা তাকে তাড়া দেয়ার পরও মান্টো কিছুক্ষণ চুপ করে থাকতো। তারপর মা তার নিজের খাবার মুখে তুলে নিলে মান্টো খেতে আসতো।
মান্টোর ছিল একটিমাত্র সবুজ রঙের ঘোড়া। মান্টো তার মায়ের সাথে লুকোচুড়ি খেলার সময় ঘোড়ার পেছন হয়ে মায়ের আঁচলের তলায় লুকাতো। তারপর একটি মিষ্টি কণ্ঠী কোকিলছানার মতো বলতো, "কুক"।
মা তখন মান্টোকে খুঁজতে থাকার ভান করতো এবং মান্টো দৌড়ে এসে মায়ের কোলের উপর আছাড় খেয়ে পড়তো।
[২]
মান্টোর মামা গতকাল এসে বলে গিয়েছিলেন, মাকে তিনি খুন করবেন। মান্টোর চোখে কোন হতাশা নেই, কোন ভয় নেই। কেবল তার চোখে মায়ের একটি ভাঙাচোরা বিদ্ধস্ত মুখের ছবি ভাসে।
মান্টো তার বাবার মুখের দিকে তাকায়। বাবার মুখও ভাবলেসহীন, যেন কোন বিপর্যয়ের ছায়াটুকু নেই। যেন ঈশ্বরের মতো একটি পবিত্র একটি সৌম্য সৌন্দর্য বাবা।
মায়ের কথিত অপরাধের বিষয়ে বাবার ইচ্ছাটুকু অনায়াসে বুঝে নেয় মান্টো। সমস্ত লোকেদের চোখে যা অপরাধ, সৌভাগ্যবান মান্টোর বাবার চোখে মা তা নন।
বাবার চোখে মা সেচ্ছায় তার ভাগ্যকে মেনে নেয়া একজন বঞ্চিত মহিওসী, যে তার শারীরবৃত্তীয় ইচ্ছা এবং অভাব কখনোই পুরোন করতে সচেষ্ট ছিলেন না এবং এক দিনের জন্য কোন এক পুরুষের কাছে সমর্পিত হওয়া ছিল তার জন্য অতি স্বাভাবিক।
মান্টোর চোখে একটি খুশীর ঝলক ঢেউয়ের মতো খেলে যায়। মান্টো সাহস পায় বড় হবার এবং কথিত সমস্ত সাধরণ মানুষকে ছাড়িয়ে যাওয়ার।
"মান্টোর বাবা ছিল সময়ের সবচেয়ে সুন্দর বাবা"।
বাবার প্রতি মান্টোর সমস্ত শ্রদ্ধা বিগলিত হয়ে ঝরে পড়তে থাকে এবং বাবাকে মনে হয় সমস্ত সাধারণকে ছাড়িয়ে যাওয়া এক পাহাড় মানুষ।
শান্ত সকালের মতো মান্টোর ভেতরের সামান্যতম জটিলতাটুকুও দূর হয়ে যায়।
গত এক বছর যাবৎ মান্টোদের বাসায় যে লোকটি সবচেয়ে বেশি আসতো সে তার মায়ের স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির চেয়ারম্যান। যেদিনই মা পেনশনের টাকা তুলে নিয়ে আসেন সেদিনই সেই বানরমুখো লোকটি আসতো। মান্টো বুঝতে পারেনা। সে ভাবে, হয়ত মা ধারের টাকা নিয়মিত শোধ করে যাচ্ছেন।
তারপর যেদিন লোকটির সাথে মায়ের ঝগড়া হলো তার পরদিনই মামা এলেন মাকে খুন করতে। মান্টো কিছুই বুঝতে পারলো না। সে যথারীতি কলেজে গেলো এবং তার সব বন্ধুদের চাহনিতে অন্য রকম কিছু একটা দেখতে পেলো।
তারপর তাকে নিয়ে কেউ কেউ ঠাট্টা করলো, কেউ কেউ সমব্যথী হলো মান্টোর এমন মা এবং তার দুর্ভাগ্যের জন্য। কিছু শিক্ষক ভেতরগত কৌতুক নিয়ে তাকে শান্তনা দেবার চেষ্টা করলো। মান্টো ছিল বরাবরের মতোই নির্লিপ্ত।
চারেপাশের ফিসফিসানির মধ্যে একটু একটু জোড়াতালি হয়ে ঠিক মান্টোর কান পর্যন্ত চলে এসেছিল একটি ঘটনা।
মান্টো যখন ঘটোনাটি সমস্ত চেতনা দিয়ে গুছিয়ে নিয়েছে, তখন তার চোখে ভেসে উঠলো গত এক বছর ধরে মায়ের পেনশনের সমস্ত টাকার কথা। মায়ের সংসার চালানোর দুরবস্থার কথা, বাবার চিকিৎসা এবং তার পড়ার খরচ দিতে গিয়ে একজন মহিলার প্রতিদিনকার ভেঙেচুড়ে যাওয়া চেহারাটির কথা!
মান্টোর কোন রাগ হলোনা। বরং গভীর রাত পর্যন্ত পড়ার সময় অক্লেশে টেবিলের পাশে বসে থাকা মায়ের সেই দুঃখী মুখটি বারবার ভেসে উঠতে লাগলো।
মান্টো পরদিন সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ছবিগুলোও পেলো। আলাদীনের চেরাগের মতো হুট করে পেলোনা, তার বন্ধুরা পরিকল্পিতভাবেই তার মোবাইলফোনে ছবিগুলো ট্রান্সফার করে দিয়েছিল।
মান্টো সেদিন বাড়ি চলে এলো। বরাবরের মতোই তার কোন ভাবলেস নেই। সে অখুশীও নয় খুশীও নয়।
তারপর থেকে মায়ের সেই ছবিগুলো বহুবার সে দেখেছে। ছবিগুলো ঠিক যেন মায়ের বিদ্ধস্ত মুখের মতোই ভাঙাচোরা। প্রতিটি ছবি যেন তার মায়ের এক একটি কুকড়ে যাওয়া মুহূর্ত।
প্রতিদিন স্নেহময়ী ক্লান্ত মায়ের প্রতি জেগে ওঠা শ্রদ্ধার মতোই মায়ের যৌনাঙ্গের ছবিগুলোর প্রতিও শ্রদ্ধায় মান্টোর মাথা বো-ডাউন হয়ে আসতে থাকে।
গল্পের শুরুতে বলেছিলাম, "মান্টো ছিল সময়ের সবচেয়ে সুন্দর সন্তান", মায়ের সমস্ত কিছুই যার কাছে ছিল শ্রদ্ধার।
[৩]
মান্টো তার বাবাকে ছবিগুলো দেখালো। বাবার ভেতরে প্রথমেই একটা ধাক্কা অনুভব করল মান্টো, তারপর শান্ত স্থিরতা। মান্টোর মনে হলো বাবার ভেতরে যেন বহুকালের যে একটা অতৃপ্তি ছিল সেটি আর নেই। বাবা যেন কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মনের মধ্যে একটি স্থির চিত্র গুছিয়ে নিয়েছেন। বাবা কি আত্মহন্তারক হতে চান, অথবা অন্য কোন কিছু?
মান্টো এই মুহূর্তে বাবাকে ঠিক বুঝতে পারেনা। সে বাবাকে পড়তে চেষ্টা করে এবং সে বাবার কাছে একটি ছবি দেখিয়ে বলে, "এই হলো আমার মানব জনমের সবচেয়ে প্রিয় পথ, সবচেয়ে পবিত্র পথ। এই হলো মায়ের বুক, আমার কাছে যা বেহেস্তের তলদেশে বয়ে যাওয়া মধু অথবা দুধের নহরের চেয়েও পবিত্র। আমি আমার পৃথিবীতে আসার পবিত্র পথকে শ্রদ্ধা করি"। মান্টোর সেইসব সন্তানদের কথা মনে পড়ে যারা তার বন্ধু হয়েছিল। অথচ ওদের এবং ওদের মায়েদের জন্য তার করুণা হয়।
মান্টোর বাবা স্নেহে সন্তানের চুল নেড়ে দেন। তারপর মাকে ডাকেন বাবা। মান্টো চলে যায় তার লাইব্রেরি ঘরে। বাবা এবং মা ততক্ষণে হয়ত অন্য কোন পরিকল্পনা করেন।
মানুষের হাতে হাতে ছড়িয়ে যাওয়া মায়ের ছবিগুলো নিয়ে মানুষ কানাঘুষা করে। মান্টোর দিকে তাকায়। মান্টো কিছুই বলে না। মান্টো ভেবে পায়না মানুষের ভুলশুদ্ধ। সে ভাবে, মানুষেরা কত সাধারণ, কত অসহায়!
পরদিন আবার মামা আসেন। তিনি মাকে খুন করতে চান। তার হাতে থাকে একটি রুপালী ছুরি। রুপালী ছুরিতে রোদ পড়ে। মান্টো কিছুক্ষণের জন্য ভয় পায় এবং মায়ের পাশে এসে দাঁড়ায়। অকথ্য গালিগালাজে মান্টোর কান বন্ধ হয়ে আসে। মামা মায়ের চুল ধরেন এবং মাটিতে ফেলে দেন। মামা হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন এবং তারপর ছুটে চলে যান। মান্টো মাকে মাটি থেকে তুলে দেয় এবং লাইব্রেরী ঘরে চলে যায়।
অসংখ্য মানুষ যখন মামাকে অপমান আর টিটকারি করে মামার মাথায় তখন খুন চাপে। মামা প্রায়ই ছুরি নিয়ে দৌড়ে আসতে থাকেন এবং আবার ফিরে যান। মামাকে মান্টোর কাছে মনে হয় মায়ের চেয়েও বেশি অসহায় কেউ।
পরদিন আসে গ্রামের মুসুল্লিদল এবং তারা ঘটনাটিকে ব্যবচ্ছেদ করতে থাকে। কেউ কেউ মুচকি মুচকি হাসে। কেউ কেউ অযথা তরপাতরপি করে। মান্টো উঠোনে এসে দাঁড়ায়, ওদের কথা শোনে। ওদের মুখভঙ্গি এবং কথাগুলো মান্টোর কাছে ভয়ানক অসভ্যতার মতো মনে হয়।
তারপর ওরা একটি শব্দ উচ্চারণ করে। ওদের বিধানে ওটাই ছিল সবচেয়ে যোগ্য শব্দ। মান্টো শব্দটি প্রথম শোনে। ওরা নিয়ম বিধান আরও কী কী নিয়ে যেন আলোচনা করে। মান্টো বোঝেনা।
মান্টোর কলেজ থেকে এরপর আসেন তার সবচেয়ে প্রিয় শিক্ষক। তিনি কিছুক্ষণ মুসুল্লিদের সাথে আলাপ করেন এবং বলেন, ওনারা স্কুল কমিটির চেয়ারম্যানের কাছে গিয়েছেন কিনা। ওনারা বলেছেন তিনি একজন সম্মানী মানুষ এবং ওনারা যান নি।
মান্টোর প্রিয় শিক্ষক চুপ করে থাকেন। তারপর আসে বৃষ্টি। ঝুৃ্ম বৃষ্টিতে ভিজে যায় উঠোনবাড়ি, গাছ এবং ঘরের সব চাল বেয়ে পড়ে মিষ্টি জল। মান্টো ঘরে আসে। মায়ের দুঃখী মুখের দিকে চেয়ে একই সাথে অনেগুলো গল্প পড়তে থাকে সে। মায়ের মুখমণ্ডল যেন কখনও কখনও এক একটি কালজয়ী গল্প হয়ে ওঠে মান্টোর কাছে।
[৪]
মান্টো এখন আর ঘর থেকে বের হয়না। ঘর থেকে বের হলে প্রায় সব মানুষ'ই ওর দিকে নিরীক্ষক দৃষ্টিতে তাকায়। হাসে। আপাদমস্তক খেয়াল করে। কেউ কেউ গালি দেয়। কেউ কেউ বলে, "তোর মাকে এক রাত এক দিন আমার কাছে থাকতে পাঠাস"।
মান্টো নির্লিপ্ত থাকে। ওদের দীনতা মান্টোকে মনে করিয়ে দেয় একটি ডেভেলপিং সাবকন্টিনেন্ট এর নিকট ভবিষ্যতের কথা এবং জনগনের জননী ও কন্যাদের দুর্ভাগ্য।
খুব নিকট ভবিষ্যতের প্রজন্মগুলো নারীকে মাংসের বাইরে চিন্তা করতে পারে না। প্রজন্মান্তরে হয়তবা আছে সুসংবাদ ও সুসংহতি।
মান্টো এখন নারী এবং পুরুষ বিষয়গুলোর জটিলতা বুঝতে শিখেছে।
এখন সে ভাবতে পারে শরীর ও সততার চিত্রগুলো। এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের সহজ পদ্ধতিগুলো। গত গল্পে একজন স্বশিক্ষিত সংশয়বাদী যা বলতে চেয়েছিলেন এবং বারবার তাকে থামিয়ে দেয়া হয়েছিল। মান্টো সেই স্বশিক্ষিত সংশয়বাদীকেও চিনতো এবং মান্টোর চিন্তাজগত এখন অনেক বিস্তৃত।
মান্টো ওদের কথা ভাবে। ভাবতে থাকে কতকাল লাগবে চলমান পরিস্থিতির প্রকৃত উন্নয়নকাল আসতে। মান্টোর ভেতরে অসংখ প্রশ্নের উদয় হতে থাকে। উন্নয়নশীলতা আসলে কী। কীসের উন্নয়ন একটি পৃথিবীর জন্য প্রকৃত প্রয়োজন।
পুজিবাদী সংস্কৃতি কি মান্টো এবং তার বন্ধু এবং নারীদের মুক্তি দিতে পারে? অথবা লেনিনবাদ বা তার অন্য কোন উকুইভ্যালেন্ট? মান্টো আকাশ পাতাল ভাবে। মান্টোর চোখে তার বন্ধু এবং কয়েক শিক্ষকের লোভাতুর চোখ ভেসে ওঠে। তার চোখে ভাসে অসহায় মায়ের পবিত্রতম এবং অসহায় যননাঙ্গের ছবিগুলো। "শ্রদ্ধা"।
তারপর চলতে থাকে আরও কয়েকটি অসভ্য দিন। নির্মম ও লোভাতুর কয়েকটি মানুষের চোখ নিয়মিত চোখের সামনে আনাগোনা করে। বর্ষার সময়টা সংখ্যাহীন এবং অসংযত দুঃস্বপ্নের মধ্যে দিয়ে কেটে যেতে থাকে।
ধীরে ধীরে মায়ের ভেতর এক ভয়ানক বিষণ্ন নিরবতা বাসা বাঁধতে শুরু করে। অথচ মা নিজেই মান্টোকে বলতেন, "হেরে যাওয়া মানেই অন্যদের জিত"। মান্টো যেন মায়ের কথাগুলো এবং মাকে মেলাতে পারেনা। তার ভেতরে নিরব অস্থিরতা খেলা করে।
কিছুদিন পরই মান্টোর সেই প্রিয় স্যারের একটি চিঠি আসে। চিঠিটি খুব বড় নয়। অল্প কিছু শব্দ এবং কয়েকটি পঙক্তিতে গাঁথা। মান্টো চিঠিটি পড়ে। মান্টোর অসাধারণ ভালোলাগে সেদিন।
মান্টো তার প্রিয় শিক্ষকের কাছে ছুটে যায়। মান্টো তাকে বলে, যেন গ্রামের নবান্নে চিঠিটি পড়ে শোনানো হয়।
স্যার ঠিক তা'ই করতে চেয়েছিলেন। একই কাজ। তিনি চেয়েছিলেন কিছু কথা মানুষকে বলতে, যেগুলো মানুষের জানা দরকার ছিল।
স্যার ছিলেন এক স্থির চরিত্রের সত্যনিষ্ঠ দার্শনিকের মতো। স্যার ছিলেন ছেলেগুলোর বাবার মতো অথবা তাদের চেয়েও ধৈর্যশীল। তিনি ছিলেন শান্ত সুহৃদসম্মিত এবং শক্তিমান ব্যক্তিত্বের এক শ্রেষ্ঠ। তিনি ছিলেন চিন্তার মুক্তিকামনায় প্রবল বিশ্বাসী। তিনি ছিলেন স্বকীয়। নিজেকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য তিনি নিজেই ছিলেন সবচেয়ে যোগ্য।
অথচ তার চারপাশে ছিল অজস্র কুক্ষিগত চিন্তক ও নরকাবাসীরা। যারা কোনদিন বের হতে পারেনি প্রাচীনতম পরিকল্পনা থেকে। যারা নারী এবং বেঁচে থাকা এবং মৃত্যু সম্পর্কে প্রাগৈতিহাসিক ধারণাগুলো চেপে ধরে থাকতে ভালোবাসতো। যারা নিজের মা এবং জন্মমূল ভালোবাসতে পারেনা কোনদিন।
তারা বিদেহী আত্মাদের মতো ভীর করতো এবং চিৎকার করে সময়গুলো পাড় করে দিতো।
প্রিয় স্যার মান্টোকে শান্তনা দিতে চান'নি। কিন্তু মান্টোর নিজেকে মনে হয়েছিল ভীষণ শান্ত, সমৃদ্ধ। মান্টো নিজ বাড়িতে ফিরে এসেছিল।
[৫]
তারপর একদিন নবান্ন আসে এবং গ্রামের সমস্ত মানুষ দহলিজে জড়ো হয়। মান্টোর প্রিয় স্যার সকলের সামনে একটি উঁচু টিলাবৎ খড়ের গাদায় উপবিষ্ট হন এবং তার পকেট থেকে একটি চিঠি বের করেন। তিনি ধীরে ধীরে চিঠিটির ভাজ খুললেন, যেমন প্রেমিকেরা ভাজ খোলে শাড়ি ও শরীরের। এটি খুব যত্ন সহকারে খোলা হয়েছিল।
তিনি মাত্র কয়েকটি লাইন পড়লেন। লাইনগুলো মান্টো দ্বিতীয়বার শুনলো। তার মনে হচ্ছিল চিঠিটি যেন এক অমরাবতী গল্পের মতো। সমস্ত মানুষ নীরব হয়ে কী যেন ভাবতে লাগলো। তাদের মুখ থেকে আর কোন কথা বের হলো না। তারা বাকরুদ্ধ হয়ে মাটিতে বসে পরেছিল। আসলে তারা প্রথমবারের মতো এমন সব কথা শুনেছিল যা তারা আর কোনদিন শোনেনি।
মান্টো ফিরে এলো। মায়ের হাতে চিঠিটি দিলো এবং মাকে স্যারের চিঠিটি পড়ার ধরণ ও জনতার ভঙ্গিগুলো একে একে বললো।
ছোট চিঠিটিতে লেখা ছিল, "আমাদের নৈতিকতা এবং ধর্মের বাইরেও এমন কিছু সত্য থাকে যা আমরা সকলেই আমাদের ভেতরে লালন করি। আমরা তা ধারণ করি অথচ স্বীকার করিনা। আমরা জিনগতভাবে প্রত্যেকেই মিথ্যুক। 'এক দিনের জন্য হলেও সত্য স্বীকার করুন এবং ভাবুন'।"
সবাই নির্বাক হয়ে একে অপরের মুখের দিকে তাকাতে লাগলো।
প্রিয় স্যার বললেন, "আমরা নারীর অব্যক্ত বাসনাগুলোকে কোনদিনই ভাবিনি। আমরা একটি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক চাহিদাকে নিয়ে হাস্যরস করি। অথচ নিজেদের ক্ষেত্রে তা সহসায় পুরণ করার ফন্দিতে আমরা সব সময়'ই প্রথম স্থান অধিকার করেছি।
যে নারী চিরকাল যৌবন বেঁধে রাখে আমরা তাকে জনতার সামনে বাহবা দেই অথচ সর্বোচ্চ গোপনীয়তা রক্ষা করে তার শ্লীলতা হানির জন্য প্রতিনিয়ত নানান কৌশল রপ্ত করতে থাকি। একজন নারীর শরীরবৃত্তীয় স্বাধীনতাকে আমরা স্বীকার করতে অপারগ। কারণ আমরা জিনগতভাবে অটোক্রেট'ও।
মনে হচ্ছিল জনতা ধৈর্যহারা হয়ে যাবে। অথচ তাদের মধ্যে গুটিকয়েক প্রবীণ ও জ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন, যারা ধমক দিলেন এবং বললেন, আপনারা চুপ করুন এবং কথাগুলো শুনুন।
কিছুক্ষণ থেমে গিয়ে স্যার আবার বললেন, "প্রতিজন পুরুষের মতো প্রতিজন নারীকেও ঈশ্বর শরীর ও কামনা দিয়েছেন। এটি বায়ুবীয় নয়, এটি মৃত্যুর মত ধ্রুব এবং সুন্দর ও সুখের। আমরা যদি তাকে সত্য মানি! অথচ আমরা বৈষম্যের ক্ষেত্রে অটল।
আমরা একজন পুরুষের অন্যায়কে নারীর উপরে চাপিয়ে দিই এবং বিকৃত আনন্দ আত্মহারা হই। অথচ আমরা জানিনা, আমাদের জানার বাইরেও আছে অসংখ্য সুমহান সত্য"।
স্যার বললেন, "নারীদের যৌন স্বাধীনতা মূল্যায়িত হোক, পুরুষের বিকৃত সুখ ও প্রভুত্ব লোপ হোক"।
স্যার নিচে নেমে এলেন এবং জনতার সাথে মিশে গেলেন।
কারো মুখে'ই কোন কথা নেই। সামান্য সময়ের জন্য সকলেই নিবিষ্ট কবি অথবা দার্শনিক। অথচ কে কতটুকু কী বুঝেছে কিছুই বলা গেল না। তবে সকলের মুখে যেন একটি পরিবর্তিত মুখোশ।
মান্টো ফিরে এসেছিল।
মান্টো এসেছিল তার লাইব্রেরী ঘরে। মূলত বইয়ে ঠাসা লাইব্রেরীটি ছিল তার একমাত্র শোবার ঘর'ও। সেদিন মান্টো নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ে। সে স্বপ্ন দেখে অসংখ্য মানুষ সত্যকে ঘিরে গল্পে মশগুল।
মান্টোর মস্তক তার মায়ের যৌননাঙ্গের প্রতি শ্রদ্ধায় নুয়ে পড়ে। কারণ এটি কেবল সংগমদ্বার নয়, এটি পৃথিবীর একটি অনন্য সৃষ্টিদ্বার। এটি পৃথিবীর প্রাণ ও পূর্ণতার দ্বার, যার ভোতর দিয়ে মান্টো এসেছিল।
মান্টো তারপর একটি ছবি আঁকে। পিকাশোর 'ইরোটিক সেন্স অব ফিগার' বা 'নিউড ইন্টু দ্য ফরেস্ট' বা 'আলজিয়ার্স এর নারী'র মতো নয়, অথচ দেখতে ঠিক ওসব আবেদনময় ছবির মতোই। কারণ নারীর যোনিপথের এই ছবির মধ্যে যৌনতা নেই, আছে প্রাণের আবির্ভাব। যারা জ্ঞানী তারা সহসায় বুঝতে পারে।
মূলত এটি একটি জন্ম বৃত্তান্তের ছবি। মান্টো ছবিটি আঁকার সময় নিজেরই জন্মের কথা কল্পনা করতো। কল্পনা করতে থাকতো একটি সামান্য পথ ও তার আকৃতির কথা এবং মায়ের মৃত্যুর শতভাগ সম্ভাবনার কথা! সে কেঁপে উঠতো! মান্টো ছিল সময়ের সবচেয়ে সুন্দর সন্তান, আগেও বলেছিলাম।
মান্টোর চিত্রকর্মটি সকলের কাছে তৎক্ষণাৎ বোধগম্য না হলেও প্রিয় স্যার বুঝতে পেরেছিলেন। ওটি ছিল অনন্য। অথচ ঠিক মায়ের যৌনাঙ্গের ছবিগুলোর মতোই চিত্রটি প্রায় সকলের কাছেই ছিল লোভনীয়।
অথচ মাত্র একশ বছর পর অসংখ্য মানুষের কাছে প্রাণের আবির্ভাব নামের এই ছবিটি হয়ে উঠবে সবচেয়ে নন্দিত চিত্রকর্ম। যে ছবির পাশে থাকবে একটি চিঠি এবং একজন নারীর যৌন স্বাধীনতার ভাস্কর্য।
শেষ...