কোথা থেকে আমাদের আগমন, কোথায় আমাদের গমন
একটু মনোযোগ দিয়ে পড়ে দেখুন
অনেক অজানা রহস্য উন্মোচিত হবে !
একটু চিন্তা করুন
কোথায় থেকে আমাদের আগমন, কোথায় আমাদের গমন, এ ব্যাপারে আমরা খুব বেশি চিন্তা করিনা ।
মৃত্যুর পর কেয়ামত পর্যন্ত আমাদেরকে যেখানে অবস্থান করতে হবে, তার জন্য আমাদের প্রয়োজন আমরা যে ভাবে যে ত্বরিকা মোতাবেক ধর্ম পালন করি তা বিশুদ্ধভাবে জেনে পালন করা এবং জানার জন্য আগ্রহ সৃষ্টি করা । এর জন্য প্রয়োজন জ্ঞান অর্জন, জ্ঞান অর্জন করতে হলে কুরআন হাদীসের আলোকে আমাদেরকে অধ্যয়ন করতে হবে, গবেষণা করতে হবে ।
সূফী সাধনায় সাধকের জন্য যে সমস্ত ধাপ গুলো রয়েছে তা বড়ই বিশাল ।
সুফী সাধনায় পাঁচটি ধাপ রয়েছে। যথা-শরীয়ত, তরীকত, মারেফত, হাকিকত, ওয়াহ্দানিয়াত । শরীয়ত ছাড়া বাকী চারটি ধাপকেই তরীকতের পর্যায়ভুক্ত বলে গণ্য করা হয় । কুরআন হাদিসের আলোকে সুফী সাধকগণ সুফী সাধনায় এই পাঁচটি ধাপ সঠিকভাবে অতিক্রম করতে পারলে সুফী সাধনার সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত হয় বলে উল্লেখ রয়েছে ।
সূফী সাধনার প্রথম ধাপ শরীয়ত : শরীয়ত শব্দটি ‘সারয়া’ শব্দ থেকে উদ্ভুত । ‘সারয়া’ শব্দের আভিধানিক অর্থ সহজ সরল পথ, প্রধান সড়ক ইত্যাদি । আবার শরীয়ত শব্দের আভিধানিক অর্থ প্রকান্ড নদী, প্রবাহিত জলস্রোত, বৃহত্তম জন সড়ক প্রভৃতি । ইসলামের পারিভাষিক অর্থে শরীয়ত হলো কুরআন সুন্নাহ (হাদীস) ইজমা (মতৈক্য) এবং কিয়াস (অনুসরণ যোগ্য) প্রমানাদি দ্বারা গৃহীত ইসলামের জীবন বিধান বা জীবন ব্যবস্থা। অর্থাৎ আল্লাহ প্রদত্ত যেসব বিধি বিধান সমূহ হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সাঃ) এর মাধ্যমে মানব জাতির প্রতি নির্দেশ ও নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে, একেই ইসলামের পরিভাষার শরীয়ত বলা হয়। ফেকাশাস্ত্রের ইমামগণ কুরআন, হাদীস, ইজমা ও কিয়াস দ্বারা মানব জাতির জীবন ব্যবস্থা যেভাবে নির্দেশ ও নির্ধারণ করে গিয়েছেন তাকেই শরীয়ত বলা হয়। ইসলামের ফেকা শাস্ত্রে ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এমনকি আন্তর্জাতিক জীবন বিধান পর্যন্ত নির্দেশিত হয়েছে । ইসলামের এই নির্দিষ্ট জীবন বিধান অনুযায়ী জীবন যাপন করা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর জন্য ফরজ কেননা পবিত্র কুরআনের ভাষায় ঘোষিত হয়েছে যে ইসলামের জীবন ব্যবস্থা ব্যতিরেকে অন্যকোন রকম জীবন ব্যবস্থাই আল্লাহর নিকট গৃহীত নয় ।
ইসলামে শরীয়ত ব্যবস্থা অনুযায়ী পরিচালিত হবার পিছনে যে উদ্দেশ্য তা হলো মানবজাতির ব্যক্তিগত জীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন এবং আন্তর্জাতিক জীবনে যাতে শান্তি, শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বিধান করা যায় এবং জীবনের স্থিতিশীলতা যাতে রক্ষা করা যায়।
শরীয়ত পন্থীদের জন্য শরীয়তের পাঁচটি কার্য সম্পাদন করা ফরজ। যেমন- ঈমান, নামাজ, রোজা, হজ্ব ও যাকাত।
হজ্ব এবং যাকাত ধনীলোকদের জন্য ফরয সকলের জন্য নয়। শরীয়ত পন্থীরা যখন শরীয়তের যাবতীয় অনুশাসন মেনে চলে এবং শরীয়তের নির্দেশাবলী তাদের জীবনে বাস্তবায়িত করেন। শরীয়তের উদ্দেশ্যাবলী জীবনে বাস্তবায়িত যখন হয়ে উঠে তখনই তার জন্য শরীয়তের শিক্ষা থেকে তরীকতের দীক্ষা নেবার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। শরীয়ত থেকে তরীকতে শিক্ষানেবার সাধনাকেই বলে সুফী সাধনার পথ । শরীয়ত ও ত্বরীকত একটি অপরটির সম্পূরক। তরীকত শরীয়তের বাহ্যিক ধর্মানুষ্ঠানগুলো আভ্যন্তরীন বিশুদ্ধতা, পরিপক্কতা, সার্থকতা ও সফলতা এনে তরীকত শরীয়ত পন্থীকে মঞ্জিলে মকসুদে পৌঁছে দেয় । যেহেতু তরীকত শরীয়ত পন্থীকে তার ত্রুটি বিচ্যুতি থেকে বাঁচিয়ে রাখার উপায় এবং উপকরণ হিসাবে কাজ করে থাকে এজন্যই শরীয়ত পন্থীকে তরীকত ব্রতী হওয়া আবশ্যক। শরীয়ত পন্থীগণ যখন তরীকতের উচ্চ স্তরে পৌঁছাতে সক্ষম হন, তখন তিনি তার মাশুকের সাথে মিলন কামনায় অধিকতর ব্যাকুল হয়ে উঠেন । মাশুকের সান্নিধ্য লাভে নিজেকে ধন্য করে নিতে চান । প্রেমময়ের প্রেমে প্রেমিকের মন প্রাণ তখন ছটপট করতে থাকে বিরহ ব্যথায় । তখন তিনি সারাক্ষণ আল্লাহ পাকের আরাধনায়-উপসনায় নিমগ্ন থাকতে ভাল বাসেন । তিনি তখন জাগতিক লোভ লালসা ও মায়ামোহ থেকে নিরাসক্ত হয়ে পড়েন । প্রেমিক তখন প্রেমময়ের প্রেমে নিজেকে বিলিয়ে দিতে চান । তখন শরীয়ত তরীকত দ্বারা অর্থবহ হয়ে উঠে । তাই শরীয়ত হলো দেহ, তরীকত হলো প্রাণ বা আত্মা । ইসলামের বাহ্যিক জীবন ব্যবস্থার নাম শরীয়ত । আর আত্মার উৎকর্ষ সাধনের নাম ত্বরিকত ।
সুফী সাধনার দ্বিতীয় ধাপ তরীকত : তরীকত শব্দটি তারীক শব্দ থেকে উদ্ভূত। তারিক শব্দের আভিধানিক অর্থ পথ বা পথ চলা । আর তরীকত শব্দের অর্থ পথ চলার নিয়ম কানুন । শরীয়ত থেকে উত্তীর্ণ হওয়ার পর তরীকতের পথ ধরে মারফত, হাকীকত ও ওয়াহ্দানিয়াতের লক্ষ্যবিন্দুতে পৌঁছা যায় তাকেই তরীকত বলা হয়। শরীয়ত থেকে মারেফতে উত্তীর্ণ হতে হলে যে পথ অনুসরণ করতে হয় সেই অনুসৃত পথের নামই তরীকত । তরীকতপন্থী সালেকের জন্য তরীকতের অজানা-অচেনা পথ চলার জন্য একজন দিশারী বা মুর্শিদের প্রয়োজন । মুর্শিদ তাঁকে পথ দেখিয়ে তাঁর গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দেন । আবার শরীয়ত পন্থীরা যখন তরীকতের পথে চলতে শুরু করেন তখন তাকে ছালেক নামে অভিহিত করা হয় । ছালেক মুর্শিদের নিকট থেকে মারেফত জগতের বহু রহস্য জেনে নেন । তরীকতের সাধন-ভজনকালে ছালেকের নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়, নানা প্রশ্নের উদ্ভব ঘটে, নতুন নতুন তত্ত্ব ও তথ্য উদ্ঘাটিত হতে থাকে। আশেক আর মাশুক মিলন স্বাদে আত্মবিভোর হয়ে যায় । মাশুকের মিলন বাসনা থেকেই হৃদয়ে সৃষ্টি হয় আল্লাহপাকের স্মরণ । ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় মহানবী হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (সাঃ) আল্লাহর প্রেমে সারাক্ষণ নিমগ্ন থাকতেন । তিনি আল্লাহর স্মরণে সর্বক্ষণ ডুবে থাকা অবস্থায় সংসার ধর্ম করতেন। প্রত্যেক সাহাবাই রাছুলের হাতে হাত রেখে বায়আত গ্রহণ করেছিলেন । এই বায়আত নবুয়ত (রেসালত) রাষ্ট্রীয় খেলাফত প্রভৃতি অর্থেই বহাল ছিল । বায়আত এখন পীর-মুরীদ অর্থে বহুল প্রচলিত । রাসুলে পাক (সাঃ) ছিলেন সমগ্র মানব জাতির দিশারী । তাঁর দেয়া দিশা থেকেই ওলিগণ লাভ করতে পেরেছেন সত্যের সন্ধান, পেয়েছেন বেলায়তের উত্তরাধিকারী । তাই তরীকত পন্থীদের কর্তব্য কামেল পীর বা মুর্শিদের নিকট বায়েত গ্রহণ করা । তার মুর্শিদের দেওয়া ছবক নিয়মিত পালন করা । পীরের দেয়া শর্ত পালনে সক্ষম মুরিদকেই তরিকতের গোপন রহস্য সম্পর্কে মুর্শিদ অবহিত করে থাকেন । তরীকত হলো রিয়াজাত-মুশাহিদার পথ, আত্মসংযম ও কঠোর সাধন ভজনের পথ । তরীকত আলমে মালাকুতের অন্তর্ভুক্ত । আলমে মালাকুতকে বলা হয় খোদায়ী জগত, ফেরেশতা জগত, আত্মজগত । এই আলমে মালাকুতে প্রবেশ করতে হলে মানব চরিত্রের কতগুলো মন্দ স্বভাব পরিহার করিতে হয় । যথা-কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মিথ্যা, হিংসা- বিদ্বেষ, লোভ-লালসা, আত্মঅহংকার, পরনিন্দা, পরশ্রীকাতরতা, জাগতিক ধন সম্পদ, ঐশ্বর্য, কৃপনতা, লোক দেখানো উপাসনা, অবৈধ কার্যকলাপ মিথ্যা, প্রতারণা, পণ্যদ্রব্যে ভেজাল মেশানো, ওজনে কম দেওয়া, ওজনে বেশি নেওয়া, অধিক মুনাফার আশায় পণ্যদ্রব্য গুদাম জাত করা, রাহাজানী, নরহত্যা, অপহরণ, মদ্যপান প্রভৃতি ।
তরিকতের প্রচলিত ৭ (সাত) আরকান এবং ৬ (ছয়) আহকাম রয়েছে ৭টি আরকান হলো
(১) আল্লাহকে জানার মত সময়উপযোগী জ্ঞানার্জন । (২) জাগতিক লোভ লালসা বিসর্জন । (৩) দুঃখ দৈন্যে ধৈর্য ধারণ (৪) আল্লাহ পাকের অনুগ্রহের বিনিময়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ (৫) হৃদয়ে আল্লাহর প্রতি ভয়ভীতি রাখা (৬) আল্লাহর স্মরণে সর্বক্ষণ নিমগ্ন থাকা (৭) মুরাকাবার মাধ্যমে স্রষ্টা ও সৃষ্টির ধ্যান ধারণায় মগ্ন থাকা ।
তরিকতের ৬ ছয় আহকাম হলো (১) আল্লাহর মারফত লাভ (২) দানশীলতা (৩) সত্যবাদিতা রক্ষায় অটল থাকা (৪) ভাগ্যলিপির উপর দৃঢ় আত্মবিশ্বাস রাখা (৫) আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীলতা বজায় রাখা । (৬) পাশব প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামরত অবস্থায় দৃঢ়পদ থাকা ।
এছাড়াও কম কথা, কম ঘুম ও কম খাবারে অভ্যস্ত হওয়া, নির্জন বাস করা । নৈতিক চরিত্রের উন্নতি সাধনের মাধ্যমে আত্মিক পবিত্রতা অর্জন করাই ত্বরীকতের মুখ্য উদ্দেশ্য । সূর্য যেমন মেঘাচ্ছন্ন হয়ে পড়লে সূর্যরশ্মি বা সূর্যের কিরণ থেকে আমরা বঞ্চিত হয়ে পড়ি, অনুরূপভাবে মানব আত্মাও পাশব প্রবৃত্তি দ্বারা তমসাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে ।
সূফী সাধনার তৃতীয় ধাপ মারেফত : মারেফত শব্দটি উরফুন শব্দ থেকে উদ্ভূত । উরফুন শব্দের আভিধানিক অর্থ জানা, কোন বিষয় সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান লাভ করা। মারেফত শব্দের পারিভাষিক অর্থ জানা/শোনা ও নিজের অভিজ্ঞতা দ্বারা যে বিষয়ে পরিপূর্ণ জ্ঞান লাভ করা হয়, তাকেই মারেফত বলা হয়। তরিকত শাস্ত্রমতে মারেফত শব্দের বিশদ ব্যাখ্যা হল, বিশ্ব সৃষ্টির পরম সত্তা মহান আল্লাহ ও তাঁর সুবিশাল সৃষ্টি জগত এবং আপন সত্তাকে জানার নামই মারেফত । নিজ এবং নিরাঞ্জনাকে জানার নামই মারেফত।
হাদীস শরীফে উল্লেখ আছে ‘‘মান আরাফা নাফচাহু ফাকাদ আরাফা রাববাহু অর্থাৎ যে ব্যক্তি নিজেকে জানতে পেরেছে সে তার প্রভূকে জানতে পেরেছে ।
তরিকতের ভাষায় মারফত অর্থ নূরে মারফত বা নুরে এলাহী তথা মহান আল্লাহ্ পাকের জ্যোতিময় দীপ্তি, পরম জ্যোতিময় সত্তার পরিচিতি লাভ, পরম প্রেমময় মহান আল্লাহ্ পাকের পূত-পবিত্র নূরের সাথে পরিচিত হওয়াকেই মারেফত বলে । মারেফতের অভিষ্ট লক্ষে পৌঁছতে হলে চারটি স্তর অতিক্রম করা অপরিহার্য। (১) ইমান : অদৃশ্য বিষয়ের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন (২) তলব : অদৃশ্য বিষয় বস্ত্তর অনুসন্ধান কার্যে লিপ্ত হওয়া (৩) ইরফান : অদৃশ্য বিষয়বস্ত্ত সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করা। (৪) ফানাফিল্লাহ : অদৃশ্য বস্ত্ততে উপনীত ও উন্নীত হওয়া । অর্থাৎ পরম প্রেমাম্পদের জ্যোতিময় সত্তার আলোকে নিজের ক্ষুদ্রতম সত্তাকে আলোকিত করে তোলা । মারেফতে পরিজ্ঞাত ব্যক্তিকে বলা হয় আরেফ বা সুফী । এই পথ অনুসরণ করেই মুসলিম বিশ্বে অগণিত সুফীর আর্বিভাব ঘটেছে । আশেক আর মাশুকের মিলন কামনাই সুফি সাধনার মর্মকথা । অদৃশ্য বস্ত্তর ধ্যান ধারণায় রত অবস্থায় সাধনা করতে করতে সুফীর হৃদয়ে এমন এক অবস্থায় সৃষ্টি হয় যা তত্বজ্ঞানের নেত্র দ্বারা সৃষ্টি জগতের পরম সত্বা মহান আল্লাহর সিফাতকে প্রত্যক্ষভাবেই অনুভব এবং উপলব্ধি করতে সক্ষম হন । এইরূপ নির্ভুল উপলব্ধির নামই ইরফান, বা আত্মোপলব্ধি জ্ঞান । সুফিগণ সাধনা বলে যখন জ্ঞানের চরম পরম সীমায় উন্নীত হয়ে থাকেন তখন তারা মহাজ্ঞানী রাববুল আলামীনের প্রদত্ত জ্ঞান প্রভায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেন । তখন তাদের ক্ষুদ্রতম জ্ঞানসত্তা মহান জ্ঞানসত্তায় মিশে কোন প্রকার ব্যবধানে দেখতে পান না । সৃষ্টি জগতের বিভেদ রেখা ভুলে গিয়ে সব একাকার দেখতে পান এরই নাম ফানাফিল্লাহ বা আল্লাহতে ফানা হয়ে যাওয়া । মারেফত হলো আল্লাহর জরাতে বিচরণ ধর্মী একটি জগত । এই জগত চেনা-অচেনা , জানা-অজানা, আলো-আঁধার মেশা একটি দ্বিধা-দ্বন্দের জগত । এই দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মাঝেই পরম প্রেমময়ের দর্শন লাভের আকাঙ্খা এবং তাকে জানার ব্যাকুলতা বার বার হানা দিতে থাকেন । এমনিভাবে মুর্শিদের সাহায্যে মারেফতের গোপন রাজ্যে প্রবেশ করে আত্ম বিভোর হয়ে থাকেন । যে সত্যে তিনি উপনীত হন, সে পরম সত্যের সন্ধান তিনি লাভ করে থাকেন, আর নিজের চিন্তা ভাবনার মধ্যে সীমিত থাকেন, নিজে নিজেই বহু কিছু উপলব্ধি করতে থাকেন যা ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না । সেই পরম সত্যের ধারণা প্রকাশ করা ভাষাজ্ঞানের বর্ণনাতীত । কেননা তা অনির্বাচনীয়, অপূর্ব, অপরূপ যা অব্যক্ত, অনন্ত ও অসীম। মারেফতে উত্তীর্ণ হতে পারলে আত্মদর্শন লাভ করা যায় পরম সত্তার পরিচিতি পাওয়া যায়। দেহের মাঝে দেহীর অবস্থান, তাই আত্মতত্ত্ব নির্ভর করছে দেহ তত্বের উপর । দেহতত্বের উপর বিজয়ী হতে পারলেই আত্মতত্বে উন্নীত হওয়া যায় । আত্মতত্বের উপনীত হতে পারলেই পরম তত্বের বা পরম সত্তায় উপনীত হওয়া যায় ।
সুফী সাধানায় চতুর্থ ধাপ হাকীকত : হাক্কুন শব্দ থেকে হাকীকুন এবং হাকীকুন শব্দ থেকে হাকীকত শব্দটির উৎপত্তি। যার আভিধানিক অর্থ বাস্তব, ধ্রুবসত্য, পরম সত্তা, সার বিষয়বস্ত্ত ইত্যাদি । ইহা খোদাতায়ালার গুণবাচক বিশেষণের মধ্যে একটি বিশেষণ ও বটে। হাকীকুন শব্দের আভিধানিক অর্থ-পরম সত্য বিষয়, যে পরম সত্য বিষয় সম্পর্কে পরিজ্ঞাত হওয়া যায় তাকেই হাকীকত বলা হয় । আবার তরীকতের অভিষ্ট লক্ষ্যে উপনীত হবার নামই হাকীকত । ইহা সুফী সাধনার চতুর্থ স্তর বা ধাপ । সুফি বা আরেফ এই স্তরে উত্তীর্ণ হতে পারলে পরম সত্যের সন্ধান ও স্বরূপ লাভ করিতে পারেন, তথা আত্মপলব্ধি করতে সক্ষম হন । এই পরম প্রেমাম্পদের ভালবাসায় নিজের অস্তিত্ববোধ হারিয়ে যায় । মহান রাববুল আলামীনের সুমহান সত্তায় আত্মবিলোপিত হয়ে পড়েন । ইহা ফানাফিল্লাহের স্তর । এই স্তরে উন্নীত আশেক তার মাশুকের প্রেমে উম্মাদনায় আত্ম বিভোর হয়ে পড়েন। একটি চিরন্তন অস্তিত্বের সন্ধান লাভ করতে পারেন। এ প্রসঙ্গে পারস্য কবি দেওয়ান হাফেজ বলেছেন, খোদার প্রেমে যে হৃদয় অনুরঞ্জিত, অবধারিত মরণেও হয়না তাঁর মরণ, সে যে চির জীবিত চির অমর। ফানাফিল্লার স্তর থেকে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর ন্যায় স্বাভাবিক কর্মজীবনে রত থাকার নামই বাকাবিল্লাহ, বাকাবিল্লাহর প্রকৃত অর্থ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর জীবন আদর্শ সুপ্রতিষ্ঠিত করা, তারই ন্যায় ধর্মে কর্মে সুস্থিত থেকে কেবল হৃদয়ে প্রেমময়ের চিরন্তন প্রেমে জাগিয়ে তোলা। খোদা পাকের সন্তুষ্টি লাভ করা ছাড়া সুফী জীবনে দ্বিতীয় কোন উদ্দেশ্যে নিহিত থাকেনা। খোদা পাকের গোপন প্রেমে যে প্রেমিক মগ্ন তাঁরই অবস্থান হাকিকতে। অর্থাৎ সত্যের সন্ধান লাভ করার নামই হাক্কিকত। নিখিল সৃষ্টির অন্তরালে যে পরম সত্য বা সত্তা লুকিয়ে আছে, সেই পরম সত্তায় উত্তীর্ণ হবার নামই হাকিকত।
এই পরম সত্যের উপলব্ধি জ্ঞান লাভ হয় পাঁচ প্রকার অনুসন্ধান পদ্ধতি দ্বারা যেমন (১) বুদ্ধি (২) অভিজ্ঞতা (৩) বিচার বিশ্লেষণ ৪) বিবর্তন মুখী মতবাদ (৫) প্রজ্ঞাবাদ।
ছালেক শরীয়তগত জ্ঞান, তরিকতগত অভিজ্ঞতা এবং মারেফতের পরিচিতি গত জ্ঞানের সমন্বয়ে আধ্যাত্মিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে অন্তদৃষ্টি সম্পন্ন মৌলজ্ঞান লাভ করে থাকেন। ফানাফিল্লাহ মানে হাকীকতে উন্নীত হয়ে তার নিজের বুদ্ধি জ্ঞান, অনুভূতি ইত্যাদি মহান সত্তার হারিফে ফেলা। যেমন এক বিন্দু জল মহাসাগরে মিশে গেলে যেমন হয়। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে-ওহে পরিতৃপ্ত আত্মা তোমার প্রভুর প্রতি সন্তুষ্টি চিত্তে এবং সন্তুষ্টি প্রাপ্ত অবস্থায় প্রত্যাবর্তন কর আর আমার প্রকৃত দাসদের অর্ন্তভুক্ত হয়ে জান্নাতে প্রবেশ কর। হাকিকতে উত্তীর্ণ সাধককে কামেল (পরিপূর্ণ মানব) বা আরেফ বিল্লাহ বলা হয়। রাসুলূল্লাহ (সাঃ) বলেন হাকীকত আমার অবস্থান সমূহ। হযরত শাহ বু আলী কলন্দর বলেছেন, হে সাধক, যতদিন পর্যন্ত তোমার আমিত্ববোধ বাকী থাকবে ততদিন পর্যন্ত তুমি তাঁর পরম বন্ধুতে পরিণত হতে পারবেনা, আর যখন তোমার আমিত্ববোধের বিলুপ্তি ঘটবে, তখনই তুমি আল্লাহর পরম বন্ধুতে পরিণত হতে পারবে। মুরাকাবা মুশাহেদার মাধ্যমে আল্লাহ পাকের একাত্ববোধ মিশে যাওয়া সম্ভব হয়। এই স্তরে উত্তীর্ণ সাধককেই সবার আগে মরতে হয়, হিসাব নেবার আগে হিসাব নিতে হয়। পরিশেষে বলতে চাই হাকিকত হলো একমাত্র আল্লাহ ছাড়া দ্বিতীয় কোন অস্থিত্ববোধ হৃদয়ে না থাকার নামই হাকিকত।
সুফী সাধনার পঞ্চম ধাপ ওয়াহ্দানিয়াত :ওয়াহেদুন শব্দ থেকে ওয়াহ্দানিয়াত শব্দের উদ্ভব ঘটেছে। ওয়াহেদ শব্দের অর্থ এক, আবার ওয়াহ্দানিয়াত শব্দের অর্থ একত্ব, যার দ্বিতীয় নাই। ওয়াহ্দানিয়াত ও হাকিকত একই বিষয়। আল্লাহর একত্ব অনাদি, অনন্ত যেই সত্তাতে কোন সংমিশ্রণ নেই, ইহা তরিকত সাধনায় সর্বশেষ স্তর। সালেক তরিকতের সকল পথ পেরিয়ে যেখানে এসে উপনীত হন। এটাই তাঁর পথ চলার অভিষ্ট লক্ষ ওয়াহদানিয়াত আলমে হাহুতের অন্তভূক্ত। আলমে হাহুত আল্লাহ পাকের নির্জন অবস্থানের নাম। তিনি চিরঞ্জীবি প্রকৃতি শূন্য অবস্থায় অবস্থান করছেন, তিনি নিঃসঙ্গ অবস্থায় আপনাতে আপনি আত্মা বিভোর ও স্থিতিশীল। আদিতে একমাত্র তিনিই ছিলেন আর কেউ ছিল না। ওয়াহদানিয়াতে উত্তীর্ণ ছালেক বা আরেফ সব কিছু বিলীন করে দিয়ে, নিজেকে ভুলে গিয়ে আল্লাহর সত্তায় স্থিতি লাভ করে থাকেন। এ অবস্থা সম্পর্কে মাওলানা রুমী বলেন তুমি যদি নিজেকে বিলীন করে দিয়ে আল্লাহর তাওহীদে অবস্থান করতে পার তাহলে তুমি তার পরম বন্ধু রূপে তাঁরই সত্তায় অবস্থান করতে পারবে।
হুজুর পাক (সাঃ) নবী হওয়ার পূর্বে ২৫ বৎসর বয়স থেকে ৪০ বৎসর বয়স পর্যন্ত আরবের হেরা পর্বতের গুহায় একাধারে বিরতিহীনভাবে ১৫ বৎসর গভীর সাধনার পরে নবুয়ত লাভ করেন। এরপর থেকে আল্লাহর বাণী শরীয়ত, তরিকত , মারেফত, হাকিকত, ওয়াহ্দানিয়াত পৃথিবীতে জারী হয়। অতএব, আল্লাহর রাসুল বেলায়তের সর্ব উচ্চ মোকাম অর্জন করে যে বিধান রেখে গেছেন তাই হলো শরীয়ত, তরীকত, মারফত, হাকিকত ওয়াহ্দানিয়াত। কাজেই ইমান, নামাজ, রোজা, হজ্ব, জাকাত ইত্যাদি পালন করতঃ কোরআনের নির্দেশ অনুযায়ী কামেল পীরের নির্দেশিত পথে তরীকত কাজের অনুশীলন করলেই আল্লাওয়ালা হওয়া যায়।
আলকোরআনে সুরা মায়েদাতে উল্লেখ আছে- তোমাদের মধ্যে প্রত্যেকের এক একটি চলার পদ্ধতি এবং বিশেষ পথ রয়েছে।