Thursday, December 26, 2019

রাগ আর ভালোবাসা
রাগ আর ভালোবাসা একটি আরেকটির বিপরীতে হলেও এক জায়গায় মিল আছে দুজনের। দুটিই অন্তহীন।
রাগ যদি মনে পুষে রাখেন, আপনি দগ্ধ হয়ে যাবেন। মনকে ভালোবাসায় ভরিয়ে তুলুন। বস্তুকে ভালো না বেসে মানুষকে ভালোবাসুন।
ইন্টারনেটের যুগে আমরা বস্তুকে ভালোবাসি, মানুষকে ভুলে যাই।
পাঠক, ভুলে যাবেননা, বস্তু শুধু ব্যবহার করার জন্য আর মানুষ শুধু ভালোবাসার জন্য।
মনকে বলুন আমি অন্যকে ভালোবাসব।
সে যদি অন্ধ বা খোঁড়া হয়, বোকা বা বধির হয় তাতে কি হয়েছে? সে তো মানুষ। হৃদয়ে ভালোবাসা চাঙ্গিঁয়ে তুলুন।
আপনার চিন্তাধারাকে নিয়ন্ত্রণ করুন কারণ সেটাই আপনার ভাষা হয়ে দাঁড়াবে।
আপনার ভাষাকে নিয়ন্ত্রণ করুন সেটাই আপনার আচরণ হয়ে দাঁড়াবে।
আপনার আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করুন কারণ সেটাই আপনার অভ্যাস হয়ে দাঁড়াবে।
আপনার অভ্যাসকে নিয়ন্ত্রণ করুন কারণ সেটাই আপনার চরিত্র হয়ে দাঁড়াবে।
আপনার চরিত্রকে নিয়ন্ত্রণে রাখুন কারণ সেটাই আপনার নিয়তি হয়ে দাঁড়াবে।
আবারো বলছি :
আপনি যেই মুহূর্তে আপনার চিন্তাধারাকে পরিবর্তন করবেন সেই মুহূর্তে আপনার জীবন পরিবর্তিত হয়ে যাবে।

Wednesday, December 18, 2019

যদি কাওকে জিজ্ঞাস করা হয় বাংলাদেশ কবে শত্রুমুক্ত হয়, সবাই চোখবন্ধ করে বলবে ১৬ ডিসেম্বর। কিন্ত পুরটা সত্যি নয়। পিকচার এখনো বাকি!
সবচেয়ে বড় যুদ্ধটি, তথা পাকিস্তানি বাহিনীর গলায় মরন কামড়টা বসানো তখনো বাকি ছিলো। যেখানে যুদ্ধ হয়েছিলো ট্যাংকের সাথে ট্যাংকের, কামানের সাথে কামানের, সৈনিকের সাথে সৈনিকের হাতাহাতি যুদ্ধ। সেদিন এক অতিমানবের আবির্ভাব ঘটেছিলো।
পড়ুন সিনেমাকে হার মানানোর মত সেই ঘটনাটি।
মুক্তিযুদ্ধের_শেষ_অধ্যায় ব্যাটল_ফর_খুলনা
১.
ডেটলাইন খুলনা, ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১। আগের দিন ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনীর কাছে। সমগ্র বাংলাদেশ তখন বিজয়ের আনন্দে উৎসবমুখর থাকলেও দেশের দক্ষিণে তখন চলছে এই সমরের সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধ। তখনও মাটি কামড়ে খুলনা দখল করে রেখেছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি অংশ, বিভিন্ন স্থানে গড়ে তুলেছে শক্ত প্রতিরোধ। এদিকে গোটা দেশ মুক্ত করা থেকে মাত্র কয়েক পা দূরে মুক্তিবাহিনী, সেই সাথে ভারতীয় সেনাবাহিনী। যুদ্ধটা তখন পরিণত অন্যরকম এক সম্মানের যুদ্ধে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য এটা এক মরণপণ লড়াই, আত্মসম্মানের যুদ্ধও বটে। এদিকে সমস্ত পূর্ব রনাঙ্গনে বিপুল বিজয় পেলেও খুলনায় এসেই প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনী।
ঢাকায় যেহেতু নিয়াজি আত্মসমর্পণ করে ফেলেছে এর আগেই, কাজেই এইখানে প্রবল লড়াই আঘাত করে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অহমে। অন্যদিকে নয় মাস ধরে গণহত্যার শিকার বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করতে মুক্তিবাহিনী তখন ব্যাগ্র হয়ে উঠেছে, সারা দেশ সাফল্যের সাথে মুক্ত করতে পারলেও এখানে এসেই আটকে গেছেন তারা। এই যুদ্ধ তখন মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন-মরণের লড়াই।বিভিন্ন কারণে এই যুদ্ধটিকে গুরুত্বের সাথে দেখা হয়। প্রথম কারণটি আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী অফিসিয়ালি আত্মসমর্পন করলেও খুলনা তখনও মুক্ত হয়নি; কাজেই খুলনা মুক্ত করতেই হবে। দ্বিতীয়ত, খুলনার এই যুদ্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি ছিল ট্যাঙ্ক, বিমান বাহিনী, নৌবাহিনী এবং পদাতিক বাহিনীর সমন্বিত অংশগ্রহন। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনী সম্মিলিত ভাবেই রণনৈপুন্যের পরিচয় দেয়। এই সময় খুলনার শিরোমণিতে যে ভয়ঙ্কর যুদ্ধটি সংঘটিত হয়, তার নাম ইতিহাসের সবচেয়ে স্মরণীয় ট্যাঙ্কযুদ্ধগুলোর তালিকায় আছে। ব্যাটল অফ শিরোমণি নামে খ্যাত এই যুদ্ধ সম্পর্কে প্রচুর রোমাঞ্চকর গল্প আছে, আছে মিথও। যেগুলোর সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে সত্য যা জানা যায়, সেটাও কম রোমাঞ্চকর নয়, বরং অনেক গল্পের চেয়েও শাসরুদ্ধকর মনে হতে পারে। এই পোস্টে রেফারেন্স হিসেবে প্রধানত খুলনার সেই যুদ্ধে অংশ নেয়া মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তানি সৈনিকদের জবানী এবং প্রত্যক্ষ্যদর্শী দেশী ও বিদেশী সাংবাদিকদের প্রতিবেদন ব্যবহৃত হয়েছে।
২.
যশোর ক্যান্টনমেন্ট ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি অত্যন্ত শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান। বিমান আক্রমণের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা সহ যশোর ছিল একটি দুর্ভেদ্য দুর্গ। বাংলাদেশের দক্ষিণ অংশের সাথে যোগাযোগের যশোরের গুরুত্বের কারণে বাংলাদেশ-ভারত সম্মিলিত বাহিনীর জন্য যশোরকে শত্রুমুক্ত করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। তবে এখানে প্রবল প্রতিরোধের মুখোমুখি হতে হয় তাদের, দু'দিন একটানা প্রচণ্ড আক্রমণের পরেও যশোর ক্যান্টনমেন্ট ছিল কার্যত অক্ষত। জেনারেল আনসারির অধীনস্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৫৭ ও ১০৭ ব্রিগেড এখানে বেশ শক্ত প্রতিরোধই গড়ে তোলে। তবে শেষ পর্যন্ত ৬ ডিসেম্বর ভোরবেলা পাকিস্তান সেনাবাহিনী যশোর ক্যান্টনমেন্ট ত্যাগ করা শুরু করে, কিছুটা রহস্যজনক ভাবেই। আট তারিখ পর্যন্ত চলে এই পিছু হটা। আনসারি ৫৭ ব্রিগেডকে নিয়ে মাগুরার দিকে অগ্রসর হয়, অন্যদিকে ১০৭ ব্রিগেড এগিয়ে যায় খুলনার দিকে। ১০৭ ব্রিগেডের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার মালিক হায়াত খান খুলনাতেই অবস্থান করছিল; বস্তুত, খুলনা থেকে নিজের ব্রিগেডকে নির্দেশ দিত হায়াত খান। যশোরে রয়ে গেল একটি ব্যাটালিয়ন, অগ্রসরমান ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং মুক্তিবাহিনীকে বাধা দিতে। প্রশ্ন হচ্ছে, সুরক্ষিত এই দুর্গ ছেড়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কেন সরে গেল?
এই প্রসঙ্গে আত্মসমর্পনের পর জিজ্ঞাসাবাদে হায়াত খান জানায়, ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বঙ্গোপসাগরে মার্কিন সপ্তম নৌবহর আসার খবরে আশান্বিত হয়ে তারা খুলনা হয়ে সাগরের দিকে এগিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। শক্তিশালী ক্যান্টনমেন্টে থাকা সত্বেও মূলত নিয়াজির দুর্বল নেতৃত্ব ও ভেঙ্গে পড়ার কারণে পাকিস্তানি সৈনিকেরা বাঁচার কোন আশা দেখেনি। শেষ ভরসা হিসেবেই মার্কিন নৌবহরের আশায় যশোর ক্যাণ্টনমেন্ট ত্যাগ করে তারা ।পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এই পশ্চাদপসরণ সব দিক থেকেই অপ্রত্যাশিত ছিল। আট নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর মঞ্জুর ওয়ারলেসে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সর্বপ্রথম জানান, পাকিস্তান সেনাবাহিনী যশোর ছেড়ে অতি দ্রুত খুলনার দিকে অগ্রসর হচ্ছে; তারা সেটা বিশ্বাস করেননি, সঙ্গত কারণেই।
প্রায় সব সমর নায়কের ধারণা ছিল যশোর ক্যান্টনমেন্টের পতন ঘটাতে কমপক্ষে এক মাস সময় প্রয়োজন হবে, সেখানে এত দ্রুত তাদের এই হাল ছেড়ে দেয়ার ঘটনা প্রথম ধাক্কায় কেউই বিশ্বাস করতে পারেননি। মেজর মঞ্জুর একজন সংবাদবাহককে পাঠিয়ে আবার খবর পাঠান। এবার টনক নড়ে মেজর জেনারেল দলবীর সিংয়ের, নিজস্ব গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে নিশ্চিত হয়ে নেন বিষয়টি । ৭ তারিখ সন্ধ্যাবেলায় যশোর ক্যাণ্টনমেন্ট ছেড়ে খুলনার দিকে অগ্রসর হন দলবির সিং ।এদিকে দশ তারিখে তারিখে খুলনার প্রবেশমুখ ফুলতলায় পৌঁছায় হায়াত খান। এখানে সাময়িক অবস্থান নিয়ে কিছুটা দূরে শিরোমণিকে একটি শক্তিশালী দুর্গে পরিণত করতে সচেষ্ট হয় তারা। সৈনিকদের কাজে লাগিয়ে দেয় হায়াত খান, স্থানীয় বাঙালিদের অস্ত্রের মুখে ভয় দেখিয়ে কাজ করতে বাধ্য করে তারা খুলনা শিল্প এলাকার ইস্টার্ন জুট মিল, আফিল জুট মিল, আলীম জুট মিল সহ প্রায় চার কিলোমিটার এলাকা জুড়ে প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী।
স্থানীয় কেবল ফ্যাক্টরিতে স্থাপন করা হয় অস্থায়ী সদর দফতর। স্থানীয় পাকা ভবনগুলো থেকে বাসিন্দাদের বের করে দিয়ে ব্যারাকে রূপান্তরিত করা হয়। স্থানীয় শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান, আটরা গিলাতলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুরুল হুদার বাড়িতে বসানো যোগাযোগ দফতর, বসানো হয় অস্থায়ী শক্তিশালী ওয়ারলেস এবং টেলিফোন। একটি অস্থায়ী হাসপাতালও বসানো হয়। সব মিলিয়ে শিরোমণিকে একটি ছোট কিন্তু শক্তিশালী ক্যান্টমেন্টে পরিণত করে হায়াত খানের বাহিনী। ফরিদপুর, পটুয়াখালি, বরিশাল থেকে পালিয়ে আশা দলগুলোকেও এখানে জড়ো করা হয় । প্রায় ১৫-২০ গজ পরপর বাংকার খনন করা হয় । চারপাশে প্রচুর ভারী অস্থ্রশস্ত্র সহ ৩২ টি ট্যাঙ্ক মোতায়েন করা হয় । এর সাথে ইপিসিএএফ ও রাজাকার বাহিনীর একটি উইং এবং ১৫০ জন আলশামসও ছিল ।
অন্যদিকে দলবির সিং যশোর থেকে খুলনার উদ্দেশ্যে এগিয়ে আসছেন, গাইড হিসেবে তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসছেন মেজর এম এ মঞ্জুর কর্তৃক নিয়োজিত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল। পথে পাকিস্তানিদের রেখে আসা অনেক প্রতিবন্ধক পার হয়ে এসে ১১ ডিসেম্বর ফুলতলা এলাকায় মুক্তিবাহিনীর একাংশ ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর নবম ডিভিশন মুখোমুখি হলো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর।মুক্তিবাহিনীর গাইড দল, ভারতীয় ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে শিরোমণিতে রেখে, এই সুযোগে আমরা দেখে আসি খুলনার অন্যান্য অঞ্চল শত্রুমুক্ত করতে কী তৎপরতা চলছে তখন।
৩.
ততদিনে খুলনার মূল শহরের পার্শ্ববর্তী এলাকাসহ জেলার বেশীরভাগ এলাকাই শত্রুমুক্ত হয়েছে, এদিকে ভারতের স্বীকৃতিও পেয়েছে বাংলাদেশ। খুলনায় অবস্থান নেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল তখন তুঙ্গে, একমাত্র খুলনা শহর শত্রুমুক্ত করাই তাদের প্রধান লক্ষ্য এখন। খুলনা তখন বিভিন্ন স্থান থেকে সরে আসা পাকিস্তানি সৈনিকদের একটি মিলনস্থলে পরিণত হয়েছে। শিরোমণিতে ১০৭ ব্রিগেড তো এসে গেছেই, এছাড়াও যেসব জায়গায় এসব পাকিস্তানি সৈনিকরা অবস্থান নেয় সেগুলো হলো - গল্লামারী রেডিও স্তেশন, খুলনা লায়ন্স স্কুল, পিএমজি কলোনী, শিপইয়ার্ড, সাত নম্বর জেটি, টুটপাড়া, নিউফায়ার ব্রিগেড স্টেশন, ওয়াপদা ভবন, গোয়ালপাড়া এবং গোয়ালখালি ।
এই অবস্থায় খুলনা শহর দখলের জন্য অগ্রসর হওয়ার জন্য মেজর জয়নাল আবেদিন খানকে নির্দেশ দেন মেজর মঞ্জুর । জয়নাল আবেদিন তখন মুজাহিদ ক্যাপ্টেন শাজাহানের অধীনস্থ ২০০ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল নিয়ে খুলনায় প্রবেশ করেছেন। তাদের সাথে যোগ দেন কপিলমুনি রাজাকার ক্যাম্পের পতন ঘটয়ে আসা মুজিব বাহিনীর একটি শক্তিশালী দল। তারা একত্রিত হয়ে একটি লঞ্চে করে বটিয়াঘাটা পার হয়ে জলমা চক্রাখালি হাইস্কুল ভবনে ক্যাম্প বানিয়ে অবস্থান গ্রহণ করেন। এর মাঝেই, দশ ডিসেম্বর সকালে লঞ্চে বসেই খুলনা আক্রমণের চূড়ান্ত পরিকল্পনা স্থির করা হয়। মেজর জয়নাল আবেদিনের সাথে এসময় পরিকল্পনা প্রণয়নে অংশ নেন মুক্তিযোদ্ধা রহমত উল্লাহ দাদু, শেখ কামরুজ্জামান টুকু, মির্জা খায়বার হোসেন, লেফটেন্যান্ট আরেফিন, ইউনুস আলি ইনু, সাহিদুর রহমান টুকু, স ম বাবর আলী সহ আরো কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ।
১৪ তারিখ মংলা থেকে এসে তাদের সাথে যোগ দিলেন খিজির আলি। দুর্ধর্ষ এই নৌযোদ্ধা ডিসেম্বরের ৮/৯ তারিখে পশুর নদীর পশ্চিম তীরে পাকিস্তানিদের একটি ক্যাম্প দখল করে দু'টি সিক্স পাউন্ডার গান ও একটি মেশিন গান দখল করেন। সিক্স পাউন্ডার গান দু'টির ফায়ারিং পিন ছিল না, খিজির আলী নিজস্ব টোটকা উপায়ে ছেনি ও মুগুর ব্যবহার করে অভিনব কায়দায় এগুলোকে ব্যবহারযোগ্য করে তোলেন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন বাংকারে অতর্কিত গ্রেনেড হামলা চালিয়ে পাকসেনাদের হত্যা করে প্রায় ৫০ ক্যান গুলি উদ্ধার করেন। একটি বিকে টাইপ ওপেন বার্জ দখল করে তাতে এই গোলাবারুদ সংযুক্ত করেন খিজির। এর সাথে যুক্ত করা হয় দু'টি স্টিলবডি লঞ্চ - হেমাটাইট ও আলেক্সান্ডার। অনুসরণ করার জন্য দু'টি কাঠের লঞ্চ সংগ্রহ করে তাতে দলের সদস্যদের রাখার ব্যবস্থা করা হয়, এদের নাম ছিল এম এল আকবর ও এম এল ভাটপাড়া। সব মিলিয়ে ছোট অথচ শক্তিশালী একটি নৌবহর গড়ে তোলেন খিজির। অতঃপর ১৪ ডিসেম্বর খুলনা দখলের চূড়ান্ত যুদ্ধে যোগ দেন তিন।
এই পরিকল্পনাতেই মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের শত্রুর বিভিন্ন অবস্থানে আক্রমণ শানানোর দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া হয়। পরিকল্পনা অনুসারে,
১) ফোহাম উদ্দিন ও নোমান উল্লাহ তাদের বাহিনী নিয়ে সেনের বাজার, রাজাপুর ও রূপসা ঘাটের দিক থেকে খুলনা শহর আক্রমণ করবেন। শিপইয়ার্ড, শিপইয়ার্ড হাসপাতাল ও গোয়ালপাড়া এলাকা থেকে যেন পাকিস্তান সেনাবাহিনী আক্রমণ পরিচালনা করতে না পারে সে ব্যাপারেও তারা ব্যবস্থা নেবেন;
২) বোরহান উদ্দিন তার বাহিনী নিয়ে চন্দনীমহল থেকে আক্রমণ করবেন ক্রিসেন্ট জুট মিল, তীতুমীর নৌঘাঁটি ও গোয়ালপাড়া পাওয়ার স্টেশনে;
৩) কুলটিয়াতে অবস্থান নিয়ে রেডিও স্টেশনে আক্রমণ করবেন ক্যাপ্টেন শাহজাহান ও তার বাহিনী;
৪) ঝাড়ডাঙ্গা ও সাচিবুনিয়ার দিক থেকে লায়ন্স স্কুলে আক্রমণের ভার পড়ে আফজাল হোসেন ও কুতুব উদ্দিনের উপর। গল্লামারীর রাস্তা যাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা ব্যবহার না করতে পারে সেই ব্যবস্থাও তারা গ্রহণ করবেন;
৫) মোশারফ হোসেনের নেতৃত্বে একটি দলের দায়িত্ব থাকবে ভৈরব নদী পার হয়ে মংলার দিকে অগ্রসর হওয়া থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে বাধা দেয়া;
৬) লেফটেন্যান্ট আরেফিন ও কমান্ডার খিজির আলী একটি গানবোট দিয়ে নদী পথে বিভিন্ন স্থানে শত্রুর অবস্থানের উপরে আক্রমণ চালাবে, স্থলে নিয়োজিত মুক্তিবাহিনীকে প্রয়োজনীয় কভার দেবে;
৭) মেজর জয়নাল আবেদিনের নেতৃত্বে ২০০ মুক্তিযোদ্ধার একটি দল সরাসরি খুলনা শহরে উঠে গিয়ে শহর দখল করবেন। জয়নাল আবেদিনের সহকারী হিসেবে দায়িত্বে থাকলেন স ম বাবর আলী ও রহমত উল্লাহ দাদু।
ঘড়ির কাটায় তখন ডিসেম্বরের ১৬ তারিখ শুরু হয়ে গেছে। মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে আসছেন খুলনার দিকে, চারদিক থেকে চালানো হবে সাড়াশি আক্রমণ। রাত বারোটা নাগাদ যার যার অবস্থানে পৌঁছে আক্রমণ শুরু করল মুক্তিবাহিনীর গ্রুপগুলো। শুরু হয়ে গেল খুলনা দখলের লড়াই।
৮.
ফুলতলাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি অংশ যে অবস্থানটি নিয়েছিল, সেটা ছিল মূলত একটি ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা। ভারতীয় সেনাবাহিনীকে কিছু সময় আটকে রেখে শিরোমণিতে সরে যাওয়ার জন্যই এই ব্যবস্থা নেয়া হয়। দলবির সিং এই ধোঁকায় বিশ্বাস করেছিলেন কি না সেটা নিশ্চিত করে বলার কোন উপায় নেই, কিন্তু ফুলতলার অবস্থানটিকে দুর্বল না করে সামনে এগিয়ে যাওয়ারও কোন উপায় ছিল না। অতঃপর ফুলতলার উপরে জোরালো হামলা শুরু করেন দলবির সিং। এর সাথে যোগ দেয় ভারতীয় বিমান বাহিনী। এইখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীও বেশ রণকুশলতার পরিচয় দেয়। ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর আক্রমণ বেশ সাফল্যের সাথেই মোকাবেলা করে তারা। উভয় পক্ষেই প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনী ফুলতলা থেকে দৌলতপুরে শিরোমণির দিকে সরে আসে। ফুলতলার যুদ্ধ ১২ তারিখ পর্যন্ত স্থায়ী হয়, এইদিন মধ্যরাতে ফুলতলা থেকে শিরোমণিতে সরে আসে হায়াত খানের বাহিনী।
১৩ ডিসেম্বর ফুলতলা এলেন মেজর মঞ্জুর, সাথে ভারতীয় রাজপুত ডিভিশনের এক বিশাল বহর। তার সাথে মুক্তিযোদ্ধা আলকাস, কুদ্দুস, রেজোয়ান ও গণি এলেন গাইড হিসেবে। ফুলতলার চৌদ্দমাইল এলাকায় অবস্থানরত শিখ বাহিনীর সাথে মিলিত হন মঞ্জুর। এবার চূড়ান্ত আক্রমণের পালা। এই উদ্দেশ্যে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর একটি অংশ ভারী অস্ত্রশস্ত্র ও ট্যাঙ্ক নিয়ে ভৈরব নদী পার হয়ে অপর পারে অবস্থান নেয় যাতে পাকিস্তানি সৈনিকেরা নদী পেরিয়ে পালাতে না পারে। বিভিন্ন এলাকা থেকে এসে জরো হওয়া মুক্তিযোদ্ধারা ব্যারাকপুর, লাকোহাটি, সিদ্ধিরপাশা, ধূলগ্রামে অবস্থান নেয় একই উদ্দেশ্যে - শত্রুকে পালাতে দেয়া যাবে না। খুলনা-দৌলতপুরের পশ্চিমের এলাকাগুলোতেও বিপুল সৈন্য সমাবেশ ঘটায় মুক্তিবাহিনী।
১৩ তারিখে একটি দুঃখজনক দুর্ঘটনা ঘটে যায়। মেজর গণি ও মেজর মহেন্দ্র সিং এর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর একটি বিরাট দল শিরোমণিতে ঢুকে পড়ে; তাদের ধারণা ছিল পাক বাহিনী দৌলতপুর থেকে সরে খুলনা শহরে চলে গেছে। জীবন দিয়ে তাদের এই ভুলের মাশুল দিতে হয়। তারা শিরোমণিতে ঢোকা মাত্রই পাকিস্তানি ট্যাঙ্কগুলো গোলাবর্ষণ শুরু করে দেয়। এই অবস্থায় প্রায় কিছুই করার ছিল না তাদের, প্রায় তিনশত ভারতীয় সৈনিক এসময় নিহত হয়। এই বিপুল ক্ষতি মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাদলকে জয়ের ব্যাপারে আরো উদগ্র করে তোলে ।
এদিন দৌলতপুর-শিরোমণি এলাকায় ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ইস্টার্ন জুট মিল এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে হাতাহাতি ও বেয়নেট যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে ভারতীয় সৈন্যরা, শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি সৈন্যরা পরাজিত হয়ে বন্দী হয়। শিরোমণিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চারটি ট্যাংক প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ শুরু করলেও ভারতীয় বিমান বাহিনীর আক্রমণে সেগুলো বিদ্ধস্ত হয়। শিরোমণি রেলস্টেশনের কাছে একটি পাকিস্তানি ট্রাক প্রচুর গোলাবারুদ নিয়ে এগিয়ে আসছিল, সেটিকে বিমান থেকে বোমা ফেলে ধ্বংস করা হয়। রেল স্টেশনের কাছেই পোস্ট অফিসে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোলাবারুদের একটি গুদাম। প্রচণ্ড বিমান আক্রমণে সেটি গুড়িয়ে যায়। পাক বাহিনীর অস্থায়ী যোগাযোগ দফতর চেয়ারম্যানে নুরুল হুদার বাড়িটি বিমান আক্রমণে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়। পাকিস্তান বিমান বাহিনী আগেই ভেঙ্গে পড়ায় ভারতের বিমান আক্রমণের বিরুদ্ধে কোন প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারেনি পাকিস্তান সেনাবাহিনী। তবে মুসলিম লীগ নেতা মুনসুর সাহেবের জুট প্রেসে শক্ত ঘাঁটি গেড়ে বসা রাজাকারেরা এসময় গুলি করে বিমান ভূপতিত করার চেষ্টা করে। প্রায় সাথে সাথেই পালটা বিমান আক্রমণে এই ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দিয়ে যায় ভারতীয় বিমান বাহিনী।
যুদ্ধের নির্মম কিন্তু অনিবার্য শিকার কোলাটেরাল ড্যামেজ হিসেবে ট্যাঙ্ক ও বিমান হামলায় প্রাণ হারান এলাকার কিছু সাধারণ মানুষ, ক্ষতিগ্রস্থ হয় কল কারখানা। আহতও হয় অনেকে।
১৪ ডিসেম্বর সারাদিনও প্রচণ্ড যুদ্ধ চলে। তবে এই সময় থেকে ভেঙ্গে পড়তে শুরু করে পাকিস্তানিদের ডিফেন্স লাইন। এর বড় কারণ ক্রমাগত যুদ্ধে গোলাবারুদ ফুরিয়ে যাওয়া। টানা যুদ্ধ করতে গিয়ে খাবারেও টান পড়েছে। খাদ্য ও গোলাবারুদ সরবরাহের সবকটি লাইন অকেজো করে দেয়া হয়েছে ততক্ষণে। ট্রাক বা গাড়িতে এসব দ্রব্য পৌঁছাবার চেষ্টা করলেও সেগুলো ধ্বংস করা করে দেয়া হচ্ছে। কাজেই শিরোমণিতে অবস্থান নেয়া পাকিস্তান সেনাবাহিনী তখন সব দিক দিয়েই কোণঠাসা। ১৫ তারিখে যুদ্ধের তীব্রতা কমে আসে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাধ্য হয় যুদ্ধবিরতিতে যেতে। শিরোমণির ঐতিহাসিক যুদ্ধের প্রথম পর্বও সেই সাথে শেষ হলো।
৫.
এদিকে ঢাকায় ততক্ষণে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে। কিন্তু খুলনায় তখনও হাল ছাড়তে নারাজ বিভিন্ন জায়গা থেকে পিছু হটে আসা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দলগুলো। বিভিন্ন পয়েন্টে চলছে প্রচণ্ড যুদ্ধ। ঢাকায় জেনারেল অরোরার মুখে চিন্তার ভাঁজ, খুলনায় উদ্বিগ্ন দলবির সিং। ব্যাপারটা এখন শুধু একটি এলাকা দখলেই সীমিত নেই, পরিণত হয়েছে ইগোর লড়াইতে। মুক্তিবাহিনীর গ্রুপগুলো তাদের নির্ধারিত অবস্থানে গিয়ে আক্রমণ শুরু করেছে। মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধাদের সাথে যোগ দিয়েছে এলাকাবাসীও।
রাত একটা নাগাদ নিজস্ব নৌবহর ও বাহিনী নিয়ে খিজির আলী পৌঁছলেন মুসলিম লীগ নেতা খান এ সবুরের বাড়ির পেছনে। নদীপথে খিজির আলী এগিয়ে যাবেন তার নৌবহর নিয়ে, আর স্থল্পপথেও সমান্তরালে এগোবেন মেজর জয়নাল আবেদিনের বাহিনী। পরিকল্পনা মেনেই এগিয়ে যেতে থাকেন তারা। খান এ সবুরের বাগান বাড়িতে গোলাবর্ষণ করতে করতে খিজির আলি এগিয়ে এলেন শিপইয়ার্ডের দিকে। শেষ রাতের দিকে শিরোমনি থেকে মেজর মঞ্জুরের কাছ থেকে ওয়ারলেসে নির্দেশ পান জয়নাল আবেদিন ও খিজির। এরপরে শুরু হয় সমন্বিত আক্রমণ।
শিপইয়ার্ড এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি অংশ ট্যাঙ্ক নিয়ে প্রস্তুত ছিল, মুক্তিবাহিনী এসে পৌঁছতেই তারা গোলাবর্ষণ শুরু করে। খিজির আলীর বাহিনীও সমানে জবাব দেয়। প্রচণ্ড যুদ্ধের পর, খিজির বাহিনীর সিক্স পাউন্ডার গানের সামনে টেকা মুশকিল হয়ে ওঠে পাকিস্তানি সৈনিকদের জন্য। ট্যাঙ্ক ফেলেই পালিয়ে যায় তারা। শিপইয়ার্ড থেকে কিছু সামনে দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরির কাছেও কিছু ট্যাঙ্ক মোতায়েন ছিল, একই ভাবে তারাও ট্যাঙ্ক ফেলে পিছু হটে যায়। এর আগে পাকিস্তানি সৈন্যরা বোট ও ফ্লাট ব্যবহার করে রূপসা নদীতে এগিয়ে যাবার পথ বন্ধ করে রেখেছিল। খিজির আলী সেই বাধা সরিয়ে অগ্রসর হতে থাকেন। নদীর তীরে পাকবাহিনীর যেসব বাংকার ছিল সেগুলো গুঁড়িয়ে দিয়ে এগিয়ে আসেন খিজির আলী। জেলা প্রশাসকের বাসভবনের কাছাকাছি এসে শত্রুর গুলিতে নিহত হন খিজির বাহিনীর গানারের হেলপার ইব্রাহিম। আহত হন আরো দু'জন। তবে এই বিপর্যয় সত্ত্বেও তাদের গতিতে ছেদ পড়েনি। বীর দর্পেই খিজির তার গানবোট নিয়ে লঞ্চ টার্মিনালের এসে থামেন, বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করেন খুলনায়। খুলনা শহর দখলের এক পর্ব সমাপ্ত হলো ।
ওদিকে জয়নাল আবেদিনের নেতৃত্বে রহমত উল্লাহ দাদু ও স ম বাবর আলী তাদের বাহিনী নিয়ে জলমা চক্রাখালি স্কুল ছেড়ে এগিয়ে আসছে গল্লামারীর দিকে। পথে প্রচন্ড যুদ্ধে দু'জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। ভোর ছটা নাগাদ গল্লামারী পৌঁছে যায় এই দলটি। এই সময় অল্পের জন্য জয়নাল আবেদিন মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যান, বদলে তার হেলমেটটি উড়িয়ে নিয়ে যায় একটি বুলেট। আরো সতর্ক ভাবে এগিয়ে এসে বাগমারায় পৌঁছে যান তারা, পথে আত্মসমর্পণ করে বহু পাকিস্তানি সৈনিক। এসময় এইসব সৈনিকের চোখে মুখে হতাশার ছাপ ছিল স্পষ্ট। জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানায়, নিশ্চিত পরাজয় জেনে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার জন্যই তারা আত্মসমর্পণ করেছে।
এদিকে সেই ভোরে জয়নাল আবেদিনের বাহিনীর গোলাবারুদ ফুরিয়ে আসছে। শেষ মুহূর্তে এসে বিপর্যয় আশঙ্কা করে হিসেব কষে গুলি খরচ করা শুরু করেন মুক্তিযোদ্ধারা। তবে এর পরে আর বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি তাদের, অচিরেই তারা হাদিস পার্ক এলাকায় পৌঁছে গেলেন। ১৭ ডিসেম্বর সকাল ৯ টায় হাদিস পার্কে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন বাবর আলী, তার সাথে যুদ্ধজয়ী শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা।
খুলনা শহর ধরতে গেলে তখন পুরোপুরি শত্রুমুক্ত, শুধু শিরোমণিতে চলছে মরণপণ লড়াই।
৬.
১৫ তারিখ যুদ্ধবিরতির পর আশা করা হয়েছিল, পাকিস্তান সেনাবাহিনী আর যুদ্ধ চালাবে না। তবে এই আশাকে ভুল প্রমাণ করে ১৬ ডিসেম্বর রাত ৯ টায় আবার কেঁপে উঠলো শিরোমণি রনাঙ্গন। এসময় হঠাৎ করেই তীব্র আক্রমণ চালায় হায়াত খানের বাহিনী। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীও পালটা জবাব দিতে শুরু করে, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। দুই পক্ষই সমানে গোলাবর্ষণ করছে, দুই পক্ষেই ক্যাজুয়ালিটি হয়ে চলেছে প্রচুর। রাত তিনটার দিকে হঠাৎ আক্রমণ আরো জোরালো করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী, হঠাৎ করে একসাথে বেশ কয়েকজন আঘাতের শিকার হন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন অফিসার সহ ৭ জন্য নিহত ও প্রায় ৩০ জন আহত হয়েছেন। মুক্তিবাহিনীর ক্ষতি হয়েছে আরো বেশী - নিহত ৩১ জন, আহত প্রায় চার গুন। রাত ৩ টা ১০ মিনিটে মেজর মঞ্জুর এয়ার কভারেজ চেয়ে মেসেজ পাঠালেন মিত্র বাহিনীর হেডকোয়ার্টারে। জানানো হলো, বিমান প্রস্তুত হয়ে আছে দমদম এয়ারপোর্টে, দূরত্ব হিসেব করে বোঝা গেল অন্তত রাতের মাঝে বিমান সাহায্য আসা সম্ভাবনা কম।
প্রচণ্ড বিপর্যয়ের এই মুহূর্তে মেজর হুদাকে সাথে নিয়ে যশোর ক্যান্টনমেন্টে ছুটলেন মেজর মঞ্জুর। সেখানে প্রায় দশ মিনিট ধরে ভারতীয় কমান্ডারের সাথে আলোচনা হয় তাদের। মঞ্জুরের দাবী ছিল, যুদ্ধের এই পরিস্থিতিতে সম্মিলিত বাহিনীর দায়িত্ব তার হাতে ছেড়ে দেয়া হোক। এয়ার কভারেজ ছাড়া এই মুহূর্তে পাকিস্তানি ট্যাঙ্কের সামনে মার খাওয়া ছাড়া উপায় নেই। কাজেই স্ট্র্যাটেজিতে পরিবর্তন প্রয়োজন। দ্বিধান্বিত ভারতীয় কমান্ডার ইতিস্তত করতে থাকলে মেজর মঞ্জুর তার কোমরের বেল্ট খুলে টেবিলে রাখেন, এর অর্থ জয়ী না হয়ে আর ফিরবেন না তিনি। ভারতীয় কমান্ডার ওয়ারলেসে দলবির সিংয়ের সাথে আলোচনা করে শেষ পর্যন্ত সম্মিলিত বাহিনীর দায়িত্ব তুলে দিলেন মেজর মঞ্জুরের হাতে। বেরিয়ে যাবার আগে তাকে আলিঙ্গন করে শুভকামনা জানাতেও ভুললেন না।যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে আসার আগে নিশ্চিত মৃত্যু ধারণা করে এক সৈনিকের কাছে একটি চিঠি রেখে যান মঞ্জুর। এক বাক্যের এই চিঠিতে তিনি শেষ বিদায় নিয়ে নেন তার স্ত্রীর কাছ থেকে।
এবার শুরু হলো চূড়ান্ত যুদ্ধ। পরিকল্পনার নতুন ছকে শিরোমণির ডানে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের কলামটিকে পেছনে সেকেন্ড ডিফেন্স এনে মেজর হুদাকে এর দায়িত্ব দেন মঞ্জুর। ফ্রন্ট লাইনের সম্মিলিত বাহিনীকে শিরোমণির ডানে ডিফেন্সে পাঠিয়ে দেন, বাম দিকের ও পেছনের তিনটি কলামকে ফ্রন্ট লাইনের ডিফেন্সে নিয়ে আসেন। ডানে ও পেছনে সেই ফাঁকা স্থান পূরণ করে সম্মিলিত বাহিনী। প্রধান সড়কের নিচে লুকিয়ে থাকা মিত্র বাহিনীর ট্যাঙ্কগুলোড় দু'টিকে সংকেত অনুযায়ী শিরোমণি-খুলনার প্রধান সড়কে ও ছ'টিকে ডানদিকের নিচু বেতে গাছের সারির পাশ দিয়ে পাক ডিফেন্সের পেছনে দ্রুত গতিতে পৌঁছে যাবার জন্য প্রস্তুত করেন, প্রচুর ক্যাজুয়ালিটির আশঙ্কা সত্ত্বেও। প্রতিটি ট্যাঙ্কের পেছনে থাকলেন ১২ জন করে সুইসাইড কমান্ডো। এর মাঝেই দ'জন মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হলেন, আহত হলেন আরো একজন। ভারতীয় বাহিনীরও একজন আহত হলেন।
ভোর পাঁচটার সামান্য আগে শিরোমণিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থানে আঘাত হানলেন মেজর মঞ্জুর। পঁচিশটিরও বেশী ট্যাঙ্ক, দেড় শতাধিক কামান, কয়েক শত মর্টার নিয়ে সবার আগে এসএসআর হাতে গুলি ছুড়তে ছুড়তে শত্রুব্যূহে ঢুকে গেলেন মঞ্জুর। পূর্বের নির্দেশ অনুসারে দু'টি টি-১৬০ ট্যাঙ্ক শিরোমণির প্রধান সড়ক দিয়ে এবং পাঁচটি একই ট্যাঙ্ক ডান দিক থেকে এগিয়ে গেল দ্রুত গতিতে। এরপরেও সব ঝাঁপসা, শিরোমণির সেই দুর্ভেদ্য পাকিস্তানি দুর্গে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর এই সম্মিলিত দলটির কী পরিণতি হলো, তা বোঝার কোন উপায় নেই তখন আর।
পরিস্থিতির ভয়াবহতা আঁচ করতে পারলেন মেজর হুদা। তার অধীনস্ত সেকেন্ড লাইনকে দ্রুত ফ্রন্টলাইন প্রতিরক্ষার দায়িত্ব বসিয়ে দিলেন। ডান দিক থেকে ছুটে আসছে মিত্রবাহিনীর ট্যাঙ্ক। প্রায় তিন মাইল এলাকা জুড়ে দুই পক্ষের কামান ও ট্যাঙ্কের গোলাবর্ষণের চিহ্ন ছড়িয়ে পড়লো। আশে পাশের ঘরবাড়ি, গাছপালা গুঁড়িয়ে যাচ্ছে; প্রবল গোলাবর্ষণের আলোতে আকাশ হয়ে উঠেছে ফর্সা। এর মাঝেই মেজর মঞ্জুর তার বাহিনী নিয়ে লড়ছেন। লড়াই চলছে ট্যাঙ্কের সাথে ট্যাঙ্কের, সেই সাথে হাতাহাতি। মুহুর্মুহু সেই আক্রমণের মুখে পিছু হটতে শুরু করে পাকিস্তানি সৈনিকরা। কেউ একজন চিৎকার করে জানিয়ে দেয় - খানেরা পালিয়ে যাচ্ছে। এর পর আর মুক্তিবাহিনী পেছনে তাকায় নি। দ্বিগুন উৎসাহে এগিয়ে গিয়ে গুঁড়িয়ে দিতে থাকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দুর্গ। ভোর পৌনে ছটা নাগাদ চলে এলো ভারতীয় বিমান বহর। প্রচণ্ড গোলাবর্ষণে শেষ হয়ে গেল ব্রিগেডিয়ার মালিক হায়াত খানের শেষ প্রতিরোধ। ১৫৭ টি মৃতদেহ ও প্রচুর আহত সৈনিক পেছনে রেখে পাঁচ শতাধিক সৈন্য সহ হায়াত খান আত্মসমর্পণ করে মেজর মঞ্জুরের কাছে।
শিরোমণির এই যুদ্ধ নিয়ে উভয় পক্ষেই প্রচুর গল্প চালু আছে। শোনা যায়, মেজর মঞ্জুর দুই হাতে এসএলআর নিয়ে গুলি করতে করতে চলন্ত একটি ট্যাঙ্কের মাঝে ঢুকে গিয়ে সেটা দখল করেন। তবে এর স্বপক্ষে কোন প্রমাণ মেলেনি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ওয়ার করেসপন্ডেন্ট মুসা সাদিক সেই যুদ্ধের একজন প্রত্যক্ষ্যদর্শী ছিলেন। তিনি যে বিবরণ দিয়েছেন তাতেও এরকম কোন ঘটনার উল্লেখ মেলে না। তবে সেই যুদ্ধের আর এক প্রত্যক্ষ্যদর্শী ইউপিআই এর ফটোগ্রাফার ডেভিড কেনারলি যে প্রতিবেদন লিখেছেন তাতে কাছাকাছি অন্য একটি ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায় । ভারতীয় এক সৈনিকের জবানিতে কেনারলি জানান - একজন সৈনিক একটি বাংকারে উঠে যান, বাংকারে থাকা পাকিস্তানি এক সৈনিকের হাত থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে গ্রেনেড নিক্ষেপ করে বাংকার গুঁড়িয়ে দেন। এখন এই ঘটনাটিই মুখে মুখে পরিবর্তিত হতে হতে ট্যাঙ্ক দখলের গল্পে পরিণত হলে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, এই গল্পের নায়ক মেজর মঞ্জুর হওয়ার সম্ভাবনাও বাদ দেয়া যায় না। তবে সেটা নিশ্চিত কিছু নয়, সত্য জানার জন্য অন্য কোন প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ জানার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।
৭.এর সাথে সাথেই শেষ হয়ে যায় শিরোমণির ট্যাঙ্ক যুদ্ধ, একই সাথে সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত হয় খুলনা। বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পুরোপুরি পরাজিত হলো। এর পর গোটা বাহিনীকে সার্কিট হাউজে নিয়ে আসা হয়, সেখানেই আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান হবে। যদিও ঢাকায় আত্মসমর্পণের পরেও যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য এই বাহিনীর প্রত্যেকের জন্য মৃত্যুদণ্ডই ছিল প্রাপ্য। কিন্তু যেহেতু ইতোমধ্যেই বিপুল সংখ্যক হতাহত হয়েছে এবং পাঁচশতাধিক সৈনিককে হত্যা করা হলে আন্তর্জাতিক জটিলতাও বাড়ার সম্ভাবনা থেকে যায়, তাই তাদের আত্মসমর্পণের সুযোগ দেয়া হয়। সার্কিট হাউজে লজ্জাজনক আত্মসমর্পণের মাধ্যমে চূর্ণ হয় মালিক হায়াত খানের দর্প, সমাপ্তি ঘটে মুক্তিযুদ্ধের শেষ অধ্যায়টিরও।
.
তথ্যসূত্র :
১) স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যূদয় - মেজর জেনারেল সুখওয়ান্ত সিং (মাসুদুল হক অনূদিত)
২) স্বাধীনতার দুর্জয় অভিযান - স ম বাবর আলী
৩) বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খুলনা জেলা - শেখ মোঃ গাউস মিয়া
৪) মুক্তিযুদ্ধ হৃদয়ে মম - মুসা সাদিক
৫) The Battle of Khulna - Brig (Retd) Muhammad Hayat Khan
.
#সূত্র_প্রীতম
#Photo: BN SWAD

Wednesday, December 4, 2019

প্রখ্যাত সুফি সাধক হযরত কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী


কুতুবুল আকতাব হযরত খাজা সৈয়দ মুহাম্মদ কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী ছিলেন একজন মুসলিম সুফি সাধক। তিনি চিশতিয়া তরিকার সাধক ছিলেন। তিনি খাজা মঈনুদ্দিন চিশতির শিষ্য এবং খলিফা ছিলেন। তার নামেই দিল্লীর বিখ্যাত কুতুব মিনার উৎসর্গ করা হয়। শিষ্যত্ব গ্রহণ করার আগেই চিশতিয়া তরিকা শুধুমাত্র আজমির এবং নাগাউর এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। দিল্লিতে স্থায়ীভাবে এই তরিকাকে প্রতিষ্ঠায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন। তাঁর দরগাহ (সমাধি) মেহরাউলের জাফর মহলের পাশেই অবস্থিত এবং পুরানো দরগাহ দিল্লিতে অবস্থিত, যেখানে তাঁর ওরশ পালিত হয়। ভারতের অনেক বিখ্যাত শাসক তাঁর ওরশ মহাসমারোহে উদযাপন করতেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন কুতুবউদ্দিন আইবাক, ইলতুতমিশ যিনি কাকীর জন্য “ঘান্দাক কি বাউলি” নামে এক গভীর নলকূপ স্থাপন করেন, শের শাহ সুরি যিনি একটি বড় গেইট তৈরী করেন, বাহাদুর শাহ ১ যিনি দরগাহের পাশে মতি মসজিদ নির্মাণ করেন, ফারুকশিয়ার যিনি মার্বেলের স্ক্রিন এবং মসজিদ নির্মাণ করেন। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত শিষ্য এবং খলিফা হলেন ফরিদউদ্দিন গঞ্জেশকার যিনি আবার দিল্লির বিখ্যাত সাধক নিজামউদ্দিন আউলিয়ার পীর (সূফি গুরু)। নিজামউদ্দির আউলিয়ার শিষ্য হলেন মুসলিম সুফি সাধক কবি আমির খসরু এবং নাসিরুদ্দিন চিরাগ-ই-দিল্লি এর পীর।
প্রাথমিক জীবন
কুতুব উদ্দিন বখতেয়ার কাকি ১১৭৩ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ কিরগিন্তানের উশ নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। ষোলতম শতাব্দিতে মোগল সম্রাট আকবরের উজির আবুল ফজল ইবনে মোবারক রচিত কুতুবউদ্দিনের জীবনী ‘‘আইন-ই- আকবর” তে উল্লেথ করা হয়, তাঁর পিতার নাম কামালুদ্দিন, কুতুবউদ্দিনের দেড় বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। খাজা কুতুবউদ্দিন এর আসল নাম বখতিয়ার এবং পরবর্তে কুতুবউদ্দিন নামটা দেয়া হয়। তিনি হোসাইন ইবনে আলী মাধ্যমে হয়ে হযরত মুহাম্মদ (দঃ) এর বংশের সাথে মিলিত হয়েছেন। তার মা, যিনি নিজেই একজন শিক্ষিত মহিলা ছিলেন, তাঁর শিক্ষার জন্য শাইখ আবু হিফসকে নিয়োগ দেন। মঈনুদ্দিন চিশতি তার ভ্রমণের সময় যখন আউশ দিয়ে যাচ্ছিলেন,খাজা বখতিয়ার তাঁর হাতে বায়াত দান করেন এবং তাঁর থেকে খেলাফত গ্রহণ করেন। এভাবেই তিনি মঈনুদ্দিন চিশতির প্রথম খলিফা হিসেবে নিযুক্ত হন।
দিল্লি গমন
দিল্লী সালতানাতের প্রতিষ্ঠাতা ইতুতমিশের (১২১১-১২৩৬) এর অবসরের সময় নিজ পীরের, মঈনুদ্দিন চিশতি, একান্ত ইচ্ছায় খাজা বখতিয়ার দিল্লিতে চলে যান এবং সেখানেই বসবাস করতে থাকেন। বখতিয়ারের আধ্যাত্বিক ক্ষমতা ও দক্ষতা এবং মানবতার অপার মহিমা অবলোকন করে প্রচুর মানুষ প্রায় তাঁর সাক্ষাত লাভে প্রতিদিনি আসা যাওয়া করতেন। তিনি এই আধ্যাত্বিক পথে সাধারণ মানুষকে বায়াত দানও শুরু করে দিয়েছিলেন।
উদারতা ও মানবতা
ফলাফলের বা প্রতিদানের আশা না করে অভাবগ্রস্থদের সাহায্য করার মতাদর্শের বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। তাঁর বিশিষ্ট শিষ্য, ফরিদউদ্দিন গঞ্জেশকার , তাঁকে কবচের (তাবিজ) বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন করেন যেগুলো ছিল বির্তকিত কেননা এগুলো ইসলামে মূর্তিপূজার মত ধর্মীয় সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। এর উত্তরে কাকি বলেন, ইচ্ছা বা বাসনার পরিপূর্ণতা হওয়া কোন কিছুর উপর নির্ভর করে না, কবচ বা তাবিজে আল্লাহর নাম এবং তাঁর কথা বা আয়াত রয়েছে এবং এগুলো মানুষকে দেয়া যাবে। সেমায় নিমগ্ন হয়ে তিনি চিশতিয়া তরিকার আধ্যাত্বিক সঙ্গীতের ঐতিহ্যকে বজায় রাখেন এবং আরো সমৃদ্ধ করেন। ধারণা করা হয় যে হিন্দু ধর্মে ভক্তি নিবেদনের সঙ্গীতের সাথে সুরের সমন্বয় করা হয়, যাতে স্থানীয় মানুষদের সাথে সর্ম্পক স্থাপনের সহায়ক হিসেবে কাজ করে এবং দুই সম্প্রদায়ের মাঝে পারষ্পরিক সমন্বয় সহজ হয়।
যেভাবে ওফাত লাভ করেন
১৪ রবিউল আউয়াল ৬৩৩ হিজরীতে (২৭ নভেম্বর ১২৩৫ খ্রিস্টাব্দ) তিনি একটি সেমা মাহফিলে অংশগ্রহণ করেন যেখানে কবি আহমদ-এ-জাম নিম্নোক্ত পংক্তিটি গেয়ে শুনান:
"যারা আত্মসর্ম্পণের খঞ্জরে নিহত হয়েছে,
অদৃশ্য থেকে তাঁরা প্রতিনিয়ত নব জীবন প্রাপ্ত হয়।"
খাজা বখতিয়ার কাকি এই আধ্যাত্বিক পঙক্তি দ্বারা এতটাই পরমা্নন্দ লাভ করলেন যে তিনি ততক্ষণাৎ মূর্ছা গেলেন। ঐ আধ্যাত্বিক পরমানন্দের মাঝেই চারদিন পর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর দরগাহ, (মাজার), দিল্লির মেহরুলে অবস্থিত কুতুব মিনার কমপ্লেক্সের নিকটে জাফর মহলের পাশে অবস্থিত। তাঁর জোর নির্দেশ ছিল, মৃত্যুর পর তাঁর নামাজে জানাজার নেতৃত্ব সে ব্যক্তিই দিবেন, যিনি কখনও কোন হারাম কাজ করেননি এবং আসরের সালাত এর সুন্নত কখনও ছাড়েননি।
উপাধির ঘটনা ও প্রাপ্ত উপাধি
কাকি নামটি দিল্লীর দিল্লির একটি ঘটনার পর তাঁর উপাধি হিসেবে যুক্ত হয়। ঘটনাসুরে, তিনি তাদের চরম দরিদ্রতা, দারিদ্র সত্ত্বেও স্থানীয় রুটিওয়ালা থেকে ঋণ না নিতে তিনি তাঁর স্ত্রীকে নিষেদ করেন। পরবর্ তিনি স্ত্রীকে বলেন, যখনই প্রয়োজন হবে তখন ঘরের এক কোণা থেকে যেন কাক (এক ধরনের রুটি) নেন। এরপর, যখনই প্রয়োজন হত আশ্চর্জনকভাবে তারঁ স্ত্রী ঘরের কোণা থেকে কাক পেয়ে যেত। ইতিমধ্যে রুটিওয়ালা এটা ভেবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল যে, কেন খাজা ঋণ নেয়া বন্ধ করে দিল। তিনি চিন্তা করলেন হয়ত তিনি প্রায়শ খাজার সাথে রাগারাগি করতেন, সেজন্য খাজা ঋণ নেয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। ফলে, রুটিওয়ালার স্ত্রী কুতুবউদ্দিনের স্ত্রীর কাছ থেকে এর কারণ জানতে চাইলেন। তিনি তাকে কাক এর আশ্চর্ জনক ঘটনাটি বর্ণা করলেন। এই গোপন রহস্যটি উন্মোচিত হওয়ার পর যদিও কাক আসা বন্ধ হয়ে যায়, ঐ দিন থেকে মানুষ কুতুবউদ্দিকে কাকি নামে সম্বোধিত করতে থাকে।
কুতুব-উল-আকতাব
মালিক- উল - মাশায়খ
রাইস-উস-সালেকীন
সিরাজ-উল-আউলিয়া